Bangla News Dunia, Pallab : আজ কৌশিকী অমাবস্যা (Kaushiki Amavasya)। বিশেষ পুজো অনুষ্ঠিত হবে তারাপীঠ (Tarapith) মন্দিরে। সেই উপলক্ষ্যে সেজে উঠেছে মন্দির চত্বর। উপচে পড়ছে পুণ্যার্থীদের ভিড়।
বৃহস্পতিবার ভোরে মঙ্গলারতির মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে মা তারার কৌশিকী আমাবস্যার তিথি। কথিত আছে পুরাযুগে শুম্ভু-নিশুম্ভ নামে দুই অসুরের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল দেবতা কুল। দেবতাকুল মহাদেবের শরণাপন্ন হলে, মহাদেব দেবীদুর্গাকে শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করার অনুরোধ করেন। সেইমতো দেবী দুর্গার কোষ থেকে দেবী কৌশিকীর উৎপত্তি হয় এবং শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করেন। সেই দিনটি ছিল অমাবস্যা তিথি। দেবী কৌশিকী শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করে দেবতাকুলকে রক্ষা করেছিলেন। তাই এই অমাবস্যা কৌশিকী অমাবস্যা নামে অভিহিত। তারাপীঠ মহাশ্মশানে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন ব্রহ্মার সপ্তম মানসপুত্র বশিষ্ঠদেব।
জনশ্রুতি রয়েছে তারাপীঠের মহাশ্মশানে শ্বেত শিমুল বৃক্ষের নীচে পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে কৌশিকী অমাবস্যার তিথিতে সাধনা করে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন সাধক বামদেব। তাই ‘সিদ্ধপীঠ’ নামে অভিহিত হয়েছে বীরভূমের তারাপীঠ। বশিষ্ঠদেব থেকে শুরু করে সাধক বামাক্ষ্যাপার অলৌকিক কাহিনী বিজড়িত মা তারার এই প্রাঙ্গণ। ঐতিহ্যবাহী তারাপীঠে যে পুণ্যার্থীরা শুধু ভক্তির টানেই ছুটে আসেন তা নয়, ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইতিহাসের টানেও এখানে ছুটে আসেন অনেকেই। দেবীর আবির্ভাব ও পৌরাণিক কাহিনী বর্ণিত আছে তারাপীঠের অঙ্গে অঙ্গে।
সমুদ্র মন্থনের সময় নীলকণ্ঠ পান করে মহাদেব শিথিল হয়ে পড়েছিলেন। দেবী দুর্গা মা তারা রূপে মহাদেবকে স্তন্যপান করিয়েছিলেন। শুক্লা চতুর্দশীর দিন সেই মা তারা রূপেই বশিষ্ঠদেবকে দেখা দিয়েছিলেন তিনি। সেই থেকে এই স্থানের নাম হয় তারাপীঠ। তবে আরও বিভিন্ন মত রয়েছে। বলা হয়, বিষ্ণুর চক্রে সতীর দেহ যখন খণ্ড খণ্ড হয়ে গিয়েছিল, সেই সময় চোখের মণি বা তারা এখানে পড়েছিল। এর বাইরেও আরও পৌরাণিক মত রয়েছে।
তারাপীঠের মা তারার প্রথম মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তারাপীঠ মহাশ্মশানে। দ্বারকা নদীর বন্যার জলে সেই মন্দির বারবার ভেঙে যাওয়ায় শ্মশান থেকে কিছুটা দূরে উঁচু জায়গায় নতুনভাবে মন্দির নির্মাণ করে সেই মন্দিরে মা তারাকে অধিষ্ঠিত করা হয়। তারাপীঠের বর্তমান মা তারার মন্দিরটি ১৮১৮ সালে বীরভূমের (Birbhum) মল্লারপুরের জমিদার জগন্নাথ রায় নির্মাণ করেছিলেন। এই তারাপীঠ আরও খ্যাতিলাভ করে সাধক বামাখ্যাপার ভক্তি ও অলৌকিক কাহিনী সমূহের মধ্যে দিয়ে। ১৮৩৭ সালে শিবচতুর্দশীর তিথিতে তারাপীঠ সংলগ্ন আটলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বামাচরণ চট্টোপাধ্যায়। ছোট বেলায় তারাপীঠের দ্বারকা নদীর তীরে মহাশ্মশানে তিনি চলে আসেন। সেখানেই সাধনা করে বামদেব মা তারার দর্শন পান এবং সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। সেই দিনটি ছিল ভাদ্র মাসের কৌশিকী অমাবস্যা। সেই প্রাচীন কাল থেকে আজও এই কৌশিকী অমাবস্যার তিথিতে তারাপীঠ মহাশ্মশানে তন্ত্র সাধনা করতে আসেন বহু তন্ত্রসাধক। অমাবস্যার তিথির নিশিরাতে তারাপীঠের মহাশ্মশানে জ্বলে ওঠে হাজারে হাজারে হোমকুণ্ড। এই বিশেষ দিনে মনস্কামনা পুরনের আশায় মা তারার পুজো দিতে আসেন লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী। তারাপীঠে মা তারার দর্শন করতে গেলে সাধক বামাখ্যাপার জন্মভিটে দর্শন করেন ভক্তরা।
এদিন বেলা ১১টা ৫৮ মিনিটে অমাবস্যা তিথি শুরু হয়েছে। তার আগে মা তারার ব্রহ্ম শিলামূর্তিকে স্নান করা হয়েছে। তারপর ফুল ও স্বর্নালঙ্কার দিয়ে রাজ রাজেশ্বরী বেশে সাজানো হয়েছে। তারপর শুরু হয়েছে মঙ্গলারতি। মঙ্গলারতির পর পুণ্যার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে মন্দিরের গর্ভগৃহের দরজা। তারপর থেকেই মা তারাকে পুজো দিতে পারছেন পুণ্যার্থীরা। আজ দুপুরে মা তারাকে অন্নভোগ নিবেদন করার আগে ফের রাজবেশে সাজানো হবে। গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ করে সবার অন্তরালে দেবীকে ভোগ নিবেদন করা হবে। এই সময় মন্দিরের দুটি দরজা বন্ধ রাখা হয়। আজকের ভোগে থাকবে পোলাও, ফ্রায়েড রাইস, ভাত, ডাল, পাঁচ রকমের ভাজা, পাঁচ রকমের তরকারি, মাছ, বলির পাঁঠার মাংস, শোলমাছ পোড়া, পাঁচ রকমের মিষ্টি, পায়েস ও কারন। ভোগ নিবেদনের পর ফের মন্দির খুলে দেওয়া হবে পুণ্যার্থীদের জন্য। সন্ধ্যায় মা তারাকে শোলার ডাকের সাজে সাজানো হবে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শুরু হবে মঙ্গলারতি। এরপর মা তারাকে খই, মুড়কি, বাতাসা, লুচি ও মিষ্টি দিয়ে শীতল ভোগ নিবেদন করা হবে। তারপর রাত্রি ৯টার পর মা তারার বিশেষ পুজো হবে। রাত ১২টার পর মা তারাকে খিঁচুড়ি ও পাঁচ রকম ভাজা দিয়ে ভোগ নিবেদন করা হবে।
আজ সারারাত মন্দির খোলা থাকবে। পুণ্যার্থীরা সারারাত পুজো দিতে পারবেন। ভোর ৩টা নাগাদ এক ঘণ্টার জন্য দেবীকে শয়নে রাখা হবে। সেই সময় মন্দিরের দুটি দরজায় বন্ধ রাখা হবে। তারপর পুণ্যার্থীদের পুজো দেওয়ার জন্য ফের খুলে দেয় হবে।
অমাবস্যা তিথি শুরু হতেই মন্দিরের পাশে থাকা তারাপীঠ মহাশ্মশানে শুরু হয়ে গিয়েছে হোমযজ্ঞ ও তন্ত্র সাধনা। সন্ধ্যার পর সেই হোমযজ্ঞের সংখ্যা আরও বাড়বে। এই কৌশিকী অমাবস্যার তিথিতে তারাপীঠ মহাশ্মশানে তন্ত্র সাধনা করতে এসেছেন বহু তন্ত্র সাধক।
তারাপীঠের মূল মন্দির সাজানো হয়েছে ফুলের মালা দিয়ে। মন্দির চত্বর সাজিয়ে তোলা হয়েছে রংবেরংয়ের আলো দিয়ে। বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। প্রবেশ পথগুলিতে বসানো হয়েছে মেটাল ডিটেক্টর গেট। নিরাপত্তার জন্য রয়েছে ১,০০০ পুলিশ কর্মী, ১,৭০০ জন সিভিক ভল্যান্টিয়ার ও মন্দির কমিটির ৩০০ জন বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মী।