কীভাবে চিরতরে দুনিয়াকে বদলে দিচ্ছেন ট্রাম্প ? বিস্তারিত জেনে নিন

By Bangla News Dunia Desk Bappaditya

Published on:

Bangla News Dunia, বাপ্পাদিত্য:- আমরা বিশ্বাস করি, এখন বিশ্বায়নের যুগ। বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির মধ্যে মেলবন্ধনের সময়। প্রযুক্তির উন্নয়ন বিভিন্ন দেশকে কাছাকাছি এনে দিয়েছে। বিশ্বের ইতিহাসে সম্পর্কের এমন নৈকট্য আগে কখনও দেখা যায়নি। আর্থিকভাবে শক্তিধর দেশ তুলনায় পিছিয়ে থাকা দেশগুলিকে সাহায্য করে। মানবিক কারণের পাশাপাশি তুলনায় বড় দেশের কাছে এটি নিজের ভাবমূর্তি ভালো করার উপায় হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে আছে। আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশ তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মতো বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে অন্য দেশের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে। তবে তার মানে এই নয় যে কোথাও কোনও উদ্বেগ নেই বা ছিল না। বিভিন্ন কারণে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি এমন দেশেরও সন্ধান মিলেছে যারা সন্ত্রাসবাদকে মদত দিয়েছে।

বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা এক্ষেত্রে খতিয়ে দেখা দরকার। বিশ্বের যে সমস্ত দেশে সুলভে শ্রমিক পাওয়া যায় তারা সেখানে উৎপাদনের কাজ শুরু করে। তার ফলে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরির খরচ অনেকটাই কমে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান লাভবান হল। তাছাড়া যাতায়াতের সুবিধা থাকায় উৎপাদিত বস্তু যে কোনও জায়গায় নিয়ে যাওয়াও সমস্য়ার বিষয় রইল না। ঠিক এভাবে চিন গোটা দুনিয়ার লজিস্টিক হাব হয়ে উঠল। বিশ্বের নির্ণায়ক হিসেবে উঠে এল কয়েকটি বড় সংস্থা। ঘটনাচক্রে তারা প্রায় সকলেই আমেরিকার থেকে সাহায্য পেত। অবশ্য একটা এমন সময়ও এসেছে যেথানে এই সমস্ত সংস্থার উপর মার্কিন নিয়ন্ত্রণ কমতে শুরু করে।

আমেরিকা দুনিয়ার বেসরকারি পুলিশ হয়ে উঠেছিল। প্রতিরক্ষার জন্য খরচ থেকে শুরু করে সামরিক এবং প্রযুক্তির দিক থেকে বিশ্বের অন্য সমস্ত শক্তিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল আমেরিকা। কে ঠিক আর কে ভুল তা তারা ঠিক করতে শুরু করল। কোন দেশে কখনও হামলা হবে তাও তাদের মর্জির উপর নির্ভর করত। কখনও আবার কোনও দেশে হস্তক্ষেপের ভয়ও তারা দেখাত। এভাবে অন্য বিভিন্ন দেশকে বশ্যতা স্বীকারও করাত আমেরিকা। তবে বন্ধু দেশগুলির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল অন্যরকম। অনেক সময় মিত্র দেশের স্বার্থকে অধিক গুরুত্বও দিয়েছে তারা। সংঘাতে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন দেশের মধ্যে নিজেদের বিশ্বাস এবং অবস্থান অনুযায়ী কয়েকটি নির্দিষ্ট দেশকে সাহায্য করেছে তারা। বিরোধিতা করেছে সেই সমস্ত শক্তির যারা আগামিদিনে আমেরিকাকে কোনওরক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারত। এখানে অবশ্য সবার আগে নিজের স্বার্থ দেখেছে তারা। আর ঠিক এই ভাবনা বিভিন্ন দেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তনেও ভূমিকা রেখেছে মার্কিন মুলুক।

বিশ্ব-বাণিজ্যের ভরকেন্দ্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা এই দেশ আমদানি থেকে শুরু করে রফতানির প্রশ্নেও বাকিদের থেকে অনেকটা এগিয়ে। আমদানির দিক থেকে আমেরিকার অবস্থান সবার আগে। রফতানির দিক থেকে দু’নম্বরে। 2022 সালে আমেরিকার আমদানির পরিমাণ ছিল 3.2 ট্রিলিয়ন ডলার। রফতানির পরিমাণ ছিল 2.1 ট্রিলিয়ন ডলার । এখান থেকেই নিজের শুল্ক নীতিকে রূপায়ণ করেছেন ট্রাম্প। বাণিজ্যের প্রশ্নে টাকার অঙ্কে থাকা ফাঁকফোকর সামাল দিতে বিভিন্ন সামগ্রী যাতে তাঁর নিজের দেশেই তৈরি হয় সে ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পাশাপাশি যে সমস্ত দেশ আমেরিকার থেকে বেশি পরিমাণে শুল্ক নিচ্ছে তাদের এই এক কায়দায় জবাব দেওয়াও শুরু করেছেন। 2024 সালের অক্টোবর মাসে মার্কিন নির্বাচনের প্রচারে ট্রাম্পকে বলতে শোনা গিয়েছিল, “যে সমস্ত সংস্থা আমেরিকা থেকে চলে গিয়েছে তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব । আমেরিকায় উৎপাদন করলে কর ছাড়ের ব্যবস্থাও করব আমরা।”

নির্বাচনের সময় যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেগুলি পূরণ করতে প্রথম থেকেই তৎপর ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউজে তাঁর এবারের ইনিংসের শুরু থেকেই তিনি বিশ্বের গতি-প্রকৃতি বদল করতে চাইছেন। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ট্রাম্প ব্যবস্থা নিয়েছেন। শুল্ক প্রসঙ্গে কার্যত যুদ্ধের মেজাজে ধরা দিয়েছেন। তাছাড়া বিভিন্ন দেশে আমেরিকা যে সাহায্য করত সেগুলিও বন্ধ করে দিয়েছেন। তালিকার শেষ এখানেই নয়। আশপাশের কয়েকটি দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে নিষিদ্ধ মাদক আমেরিকায় ঢুকছে। মাদক পাচার বন্ধ করতে না পারায় সেই সমস্ত দেশের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিয়েছেন আমেরিকার প্রথম নাগরিক। এর পাশাপাশি দুনিয়াজুড়ে চলতে থাকা বিভিন্ন সংঘর্ষ নিয়ে তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সেগুলি আবার আমেরিকার মিত্র দেশগুলির থেকে অনেকাংশেই আলাদা।

ট্রাম্পের এই সমস্ত নীতির ফলে অন্য দেশগুলিকেও একপ্রকার বাধ্য হয়ে বিভিন্ন পরিবর্তনের পথে হাঁটতে হচ্ছে। কোনও কোনও দেশকে বাণিজ্যের প্রশ্নে এতদিন ধরে চলে আসা নীতিতে বদল আনতে হচ্ছে। কাউকে আবার আমেরিকায় থাকা অবৈধ অভিবাসীদের ফিরিয়ে নিতে হচ্ছে। তার দেশের নাগরিকদের হাত-পা শিকলে বেঁধে মার্কিন সামরিক বিমান ফিরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে-এটাও মেনে নিতে হচ্ছে। আমেরিকা এতদিন ধরে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রকল্পে আর্থিক সাহায্য় করত। সেটা বন্ধ হওয়ায় এখন অন্য পথে হাঁটতে হচ্ছে দেশগুলিকে। ভারতেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বলতে হচ্ছে, “সংসদের গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন শুরুর আগে দেশে অশান্তি বাড়ে এমন কোনও উদ্যোগ নেয়নি কোনও বৈদেশিক শক্তি। “

Donald Trump  Vladimir Putin

আমেরিকার ব্রাটেলবরার রাস্তায় ট্রাম্প ও পুতিনের ভূমিকার প্রতিবাদ চলছে (ছবি: সংবাদসংস্থা এপি)

 

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলতে থাকা সংঘাত শেষ করতে বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন ট্রাম্প। রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে চলতে থাকা যুদ্ধ শেষ করতে চাইলেও তিনি ইজরায়েলের সামরিক আগ্রাসনের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন। গাজা বা অন্য কোথাও ইজরায়েল-বিরোধী কোনও ঘটনা ঘটলে তার জবাব যাতে তেল আভিভ দিতে পারে সেই রাস্তা ট্রাম্প খুলেই রেখেছেন। বিশ্বের পশ্চিম প্রান্তের বিভিন্ন দেশ একত্রিত হয়ে ন্যাটো তৈরি করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। সেই ন্যাটোর অস্তিত্ব এবং গুরুত্ব নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠে গিয়েছে । ট্রাম্প-রাজে ন্যাটো গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে পারে এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইউরোপ দীর্ঘদিন ধরেই আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু তারাও এখন স্বস্তিতে নেই। আমেরিকা জানিয়ে দিয়েছে, নিরাপত্তার প্রশ্নে সবসময় যে পাশে থাকবে এমনটা না-ও হতে পারে। ফলে ইউরোপ এখন সামরিক খরচ বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে। নিরাপত্তায় থাকা ফাঁকফোকর পূরণ করার চেষ্টা করছে । শুল্ক-যুদ্ধ ইউরোপের জন্য চিন্তার কারণ।

ট্রাম্পের বিশ্ব-দর্শনের মোকাবিলা কোন পথে হবে তা নিয়ে অন্য বিভিন্ন দেশ ভাবিত হয়ে পড়েছে। ওয়াশিংটনে ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করতে আসা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতারা ট্রাম্পের প্রশ্ন-বাণ সামলাতে তৈরি হচ্ছেন। তাঁরা জানেন, ট্রাম্প তাঁদের দেশের বিভিন্ন নীতি নিয়ে প্রশ্ন করবেন। সেই সব নীতির ফলে আমেরিকা কীভাবে প্রভাবিত হয়েছে তাও বলবেন। উত্তরে নিজেদের পদক্ষেপ সবিস্তারে উল্লেখ করেছন ওই সমস্ত নেতারা। তাঁর মধ্যে থাকা সম্প্রসারণবাদেরও পরিচয় ট্রাম্প দিয়েছেন। গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে চেয়েছেন। কানাডাকে আমেরিকার অংশ হয়ে যেতে বলেছেন। ইতিহাস জানে, এমন কথা আগে কখনও শোনা যায়নি।

ট্রাম্পের প্রথম এবং দ্বিতীয় কার্যকালের মধ্যেও ফারাক আছে। প্রথমবার রাষ্ট্রপতি হয়ে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে এনেছিলেন তিনি। তাঁর আগে রাষ্ট্রপতি থাকা বারাক ওবামা এই চুক্তি করতে চেয়েছিলেন। তাঁর সময়কালে হয়ে ওঠেনি বলে বিষয়টি আসে ট্রাম্পের কাছে। সেবার রাজি না হলেও এবার অবশ্য ইরানের সঙ্গে চুক্তিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন তিনি । চিঠি লিখে প্রস্তাব দিয়েছেন। রাজি না হলে সামরিক অভিযানের ভয়ও দেখিয়েছেন। তবে ইরান চুক্তি করতে রাজি হয়নি। কোনও দেশই যে হেনস্থা হতে চাইবে না সেটা অনুধাবন করা খুব কঠিন কাজ নয়।

পাশাপাশি বিশ্বের কয়েকটি সংস্থা থেকেও আমেরিকাকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ করেছেন ট্রাম্প। যেখানেই তাঁর মনে হয় কোনও একটি সংস্থা আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা করছে না, সেই সংস্থার সদস্যপদ ছেড়ে দেন তিনি। তালিকায় আছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং প্যারিস অ্যাকর্ড। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের উপরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন তিনি। তার কারণ, এই আদালত আমেরিকার মিত্র দেশ ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করে চলা কয়েকটি সংস্থা এতদিন আমেরিকার অর্থের উপর নির্ভর করত। সেই অনুদান বন্ধ হওয়ায় এখন তাদের কাছে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই মুশকিল হয়ে উঠেছে। সব দেখে হতাশ হওয়া ছাড়া রাষ্ট্রসঙ্ঘের খুব একটা কিছু করার নেই এখানে।

ট্রাম্প বিশ্বায়নের পথ থেকে সরে আসছেন । বিভিন্ন চুক্তি ছেড়ে বেরিয়ে এসে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। বহুদেশের মিলিত ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের কর্মকাণ্ড দুটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছেন। শুল্কের প্রশ্নে তিনি যে কার্যত যুদ্ধের ঘোষণা করে দিয়েছেন তারও বিরাট প্রভাব পড়েছে আমেরিকার শেয়ার বাজারে । সম্প্রতি অনেকটাই পড়েছে বাজার । তথ্য বলছে, 2022 সালের সেপ্টেম্বর মাসের পর এমন অবস্থা আর কখনও তৈরি হয়নি।

শুল্কের প্রশ্নে হুমকির মুখে পড়া দেশগুলি পাল্টা লড়াইয়ের পথ ধরেছে। বোঝা যাচ্ছে, আর অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্ব-বাণিজ্য বহু পক্ষের বদলে দ্বিপাক্ষিক বিষয় হয়ে উঠবে। সামরিক-সমঝোতাও ধাক্কা খেত পারে। বর্তমান সমীকরণ নিয়ে ন্যাটোও যে চলবে এমন ভাবার খুব একটা কারণ নেই। ইউরোপ সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে মন দিয়েছে। তাছাড়া স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আমেরিকা কোথাও বাহিনী পাঠালে তার জন্য মোটা অঙ্কের টাকাও নেবে । গোটা দুনিয়াকে যেন বলে দিতে চাওয়া হচ্ছে, আমেরিকা আর বিশ্বের পুলিশকর্মীর ভূমিকায় থাকতে চাইছে না।

মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে বিশ্বের ভাবনা বদলে দিয়েছেন ট্রাম্প । এমন দৃষ্টিভঙ্গি আগে কখনও তৈরি হয়নি। প্রতিটি দেশ বাইরের বিশ্বের পরিবর্তে নিজেদের কথা বেশি ভাবতে শুরু করেছে। সবচেয়ে মজার কথা, ট্রাম্পের মেয়াদ সবে শুরু হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দুনিয়া এতটা বদলাবে যে তার প্রভাব দীর্ঘ সময় পর্যন্ত থেকে যাবে।

Bangla News Dunia Desk Bappaditya

মন্তব্য করুন