Bangla News Dunia, বাপ্পাদিত্য:- ২০২৪ সালের জুলাই-অগস্টে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান এবং রাজনৈতিক পালাবদলের সময়ে হওয়া হিংসা ও অন্যান্য ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি একটি ১১৪ পাতার বিশদ তথ্য-অনুসন্ধান রিপোর্ট প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার দফতর। সেই রিপোর্টে উঠে এসেছে ক্ষমতায় টিকে থাকতে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাষ্ট্রশক্তির নির্মম অপব্যবহারের প্রসঙ্গ। সেই সঙ্গে ৫ অগস্টের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মানবাধিকার লঙ্ঘন হওয়ার পাশাপাশি হিংসার নানা ঘটনার বিবরণ।
সেই সূত্র ধরে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে একটি পোস্ট শেয়ার করা হয়েছে। যেখানে দাবি করা হচ্ছে, জুলাই-অগস্ট মাসে বাংলাদেশে কোনও সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেনি এবং সাম্প্রদায়িক হিংসায় ১ জনও নিহত হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পেজ থেকে এই পোস্ট শেয়ার করে এর ক্যাপশন এবং ফটোকার্ডে লেখা হয়েছে, “রাজনৈতিক সহিংসতাকে সাম্প্রদায়িকতার মোড় দিতে চেয়েছিলো দেশের একটি কুচক্রী মহল এবং ভারতীয় মিডিয়া। কিন্তু তাদের সেই দাবি যে বিভ্রান্তিকর অপতথ্য সেটাই জাতিসংঘের রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন, জুলাই-আগস্টে সাম্প্রদায়িক সংহিংসতায় ১ জনও নিহত হয়নি।”
অর্থাৎ এখানে মূলত দুটি দাবি করা হয়েছে। প্রথম, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংসা হয়েছে এটি অপতথ্য বা অসত্য। দ্বিতীয়, সাম্প্রদায়িক হিংসায় এই দুই মাসে একজনেরও মৃত্যু হয়নি।
আজতক ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে এই দুটি দাবিই বিভ্রান্তিকর। প্রথমত, রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্টে সাম্প্রদায়িক হিংসার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। দ্বিতীয়ত, সাম্প্রদায়িক হিংসায় মৃত্যুও হয়েছে।
আরও পড়ুন:- মহিলাদের জন্য সেরা 5 অনলাইন কোর্স। বাড়ি বসে শিখে প্রতিমাসে হাজার হাজার টাকা রোজগার করুন
যেভাবে জানা গেল সত্যি
কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার দফতরের ওয়েবসাইটে খুব সহজেই এই ১১৪ পাতার রিপোর্টটি খুঁজে পাওয়া যাবে। এই রিপোর্ট আগাগোড়া খতিয়ে দেখে এমন কিছু বিষয় উঠে এসেছে যা থেকে প্রমাণ হয় দাবিটি বিভ্রান্তিকরই শুধু নয়, অসত্যও বটে।
প্রথমেই যে বিষয়টি আমাদের নজরে আসে তা হলো-রিপোর্টের ১ নম্বর পাতায় ইন্ট্রোডাকশন পর্বের ২ নম্বর পয়েন্টে উল্লেখ করা হয়, “এই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টটি মূলত ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ অগস্টের মধ্যে ঘটা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অপব্যবহার মতো ঘটনা এবং তার প্রধান কারণ নথিবদ্ধ করেছে।” এখান থেকে প্রথমেই একটা বিষয় পরিষ্কার হয় যে ১৫ অগস্টের পর থেকে ঘটা ঘটনাগুলির নজির এখানে নথিভুক্ত করা হয়নি।
এর পরবর্তী উল্লেখযোগ্য বিষয় দেখা যায় ৩ নম্বর পয়েন্টে। যেখানে লেখা হয়, ‘উপলব্ধ সময় এবং সংস্থান কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার দফতর হিংসা এবং হানাহানির একটি প্রতিনিধিত্বমূলক স্যাম্পেল/নমুনা নথিবন্ধ করে তা প্রকাশ করেছে, তবে সমগ্র বাংলাদেশের ঘটনাগুলি এখানে কভার করা হয়নি।’ অর্থাৎ এখানে আরেকটি বিষয় জানা যায় যে এই রিপোর্টটি ১ জুলাই থেকে ১৫ অগস্টের মধ্যে ঘটনা ঘটনাগুলির একটি স্যাম্পেল এবং সমগ্র বাংলাদেশের সকল ঘটনা নয়।
এরপর এই রিপোর্টের ৫৫ নম্বর পাতার ২৩০ নম্বর পয়েন্টে আমরা দেখতে পাই, বিশেষ বিশেষ কিছু সম্প্রদায়, জাতি, এবং রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের উপর হামলা ও হিংসার একটি প্যাটার্নের কথা সেই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে রাজনৈতিক দলের সমর্থক বলতে অবশ্যই আওয়ামী লীগের কথা বোঝানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের সমর্থকদের উপর হামলার দৃষ্টান্তগুলি পৃথকভাবে ৫২ নম্বর পাতার এক নম্বর পয়েন্টে উল্লেখ পেয়েছে।
রিপোর্টের ২৩২ নম্বর পয়েন্টে “হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং উপাসনালয়ে আক্রমণ এবং সংশ্লিষ্ট স্থানচ্যুতি” শীর্ষক অংশে লেখা হয়েছে, “পূর্ববর্তী সরকারের পতনের পর হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং উপাসনালয়ে ব্যাপক আক্রমণের খবর পাওয়া যায়। বিশেষ করে ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট এবং দিনাজপুরের মতো গ্রামীণ এবং ঐতিহাসিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ এলাকায়। সেই সঙ্গে সিলেট, খুলনা এবং রংপুরের মতো অন্যান্য স্থানেও।” সেখানে আরও লেখা হয়, “এই ধ্বংসযজ্ঞ বিশেষ করে সেই সব এলাকায় হয়েছিল যেখানের মানুষ আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে মনে করা হত। কারণ হিন্দুরা এই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত বা এর সমর্থক বলে একটি বদ্ধমূল ধারণা প্রচলিত রয়েছে।”
২৩৩ নম্বর পয়েন্ট অনুযায়ী, রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধিরা এই সকল এলাকার হিন্দু ব্যবসায়ী-সহ বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন যে, “তাদের ব্যবসা, বাড়ি, জমি এবং ধর্মীয় স্থানগুলিকে টার্গেট করা হয়েছে। অন্যদিকে হিন্দুদের মালিকানাধীন দোকানগুলিকেও লুট করা হয়েছে। হিংসাযজ্ঞে প্রায়শই সম্পত্তি ধ্বংস করা, আগুন দেওয়া এবং হুমকি-শাসানি জড়িয়ে ছিল। অপর্যাপ্ত পুলিশি পদক্ষেপের ফলে আরও জটিলতা দেখা দেয়, যা পদ্ধতিগত দায়মুক্তি এবং সম্ভাব্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন সাক্ষাৎকারী বলেছেন যে ঠাকুরগাঁওয়ে হিন্দু শ্মশান এবং মন্দির ভাঙচুর করা হয়েছে। অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীরা বর্ণনা করেছেন যে, তাদের সম্পত্তিতে হামলার পর সাম্প্রদায়িক হিংসার ভয়ে সেই গ্রামগুলি থেকে প্রায় তিন-চার হাজার হিন্দু ভারতের সীমান্তের কাছে আশ্রয় চেয়েছিলেন, কিন্তু ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (BSF) তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলি নিরাপত্তাহীনতা এবং আর্থিক ক্ষতির কথা জানিয়েছে, যার মধ্যে অনেকেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, গবাদি পশু এবং ব্যবসা হারিয়েছেন।”
এ ছাড়াও, রিপোর্টের ২৩৬ নম্বর পয়েন্টে প্রকাশ পায় যে বাংলাদেশের ন্যাশনাল সিকিওরিটি ইন্টেলিজেন্স এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সূত্র থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশনকে জানানো হয়েছে, যশোর, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, নাটোর, দিনাজপুর, চাঁদপুর, শরীয়তপুর, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, মেহেরপুর, বরগুনা, বরিশাল, রাজবাড়ী, ঠাকুরগাঁও, ফরিদপুর, পিরোজপুর, নেত্রকোনার মতো জায়গায় ৫ থেকে ১৪ অগস্ট পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ৩৭টি সহিংস আক্রমণ হয়েছে। এর মধ্যে চারটি মন্দিরেও হামলা হয়েছিল।
আরও পড়ুন:- রেখা গুপ্তা কে? কেন তাঁকে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী করল BJP?
সেই সঙ্গে লেখা হয়, চলতি বছর জানুয়ারিতে বাংলাদেশ পুলিশ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেই রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশ হিন্দু বুদ্ধ খৃষ্টান ইউনিটি কাউন্সিল নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তরফে দেওয়া ১৭৬৯টি হামলার ঘটনা খতিয়ে দেখেছে পুলিশ। যেখানে দেখা গেছে, এর মধ্যে ১২৩৪টি ঘটনার নেপথ্যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা রয়েছে। ১৬১ দাবি ছিল ভুয়ো। এবং ২০টি হামলা ছিল সাম্প্রদায়িক হিংসার কারণে।
এ ছাড়াও, ২৩৭ নম্বর পয়েন্টে দেখা যায়, আহমদীয়া মুসলিম সম্প্রদায়, যা মূলধারার মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত নয় এবং ভিন্ন সম্প্রদায় বলে ধরা হয়, তাদের উপরও হিংসাত্মক হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২০২৪ সালের ৫ অগস্ট ধর্মীয় আলেমদের নেতৃত্বে একটি দল পঞ্চগড় জেলায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকজন সদস্যের উপর আক্রমণ করে এবং ১১৭টি বাড়ি এবং একটি মসজিদ ধ্বংস করে। শুধু তাই নয়, পঞ্চগড়ে এক ১৬ বছর বয়সী যুবকের উপর হামলা হয়। কিন্তু মাথায় অস্ত্রপচার করেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
সেই সঙ্গে বাংলাদেশি সংবাদপত্র প্রথম আলোর প্রকাশিত ১১ জানুয়ারির একটি রিপোর্টে পুলিশি অনুসন্ধানকে উদ্ধৃত করে লেখা হয় যে, ৪ অগস্ট থেকে ২০ অগস্ট পর্যন্ত ২০টি হিংসার ঘটনা সাম্প্রদায়িক কারণে ঘটেছে। বাংলাদেশ ভিত্তিক ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা রিউমর স্ক্যানারও নিজেদের একটি রিপোর্টে জানিয়েছে যে “জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী জুলাই-আগস্টে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ১ জনও নিহত না হওয়ার দাবিটি মিথ্যা।” যা থেকে বুঝতে বাকি থাকে না, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে যেভাবে দাবি করা হয়েছে যে “কুচক্রী মহল এবং ভারতীয় মিডিয়া” রাজনৈতিক হিংসাকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু এমনটা হয়নি; সেই দাবিটি সঠিক নয়। রাষ্ট্রসংঘের বিস্তারিত রিপোর্টে একাধিক সাম্প্রদায়িক হিংসা, এবং এর কারণে মৃত্যুর দৃষ্টান্তও রয়েছে।
এই বিষয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার দফতরের মতামত জানতে চেয়ে আমাদের পক্ষ থেকে সেখানে একটি ই-মেল করা হলে সেখান থেকে জবাব আসে যে শীঘ্রই এই বিষয়ে তারা বিশদে আমাদের জানাবেন। এই বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা এলে প্রতিবেদনটি আপডেট করে দেওয়া হবে।
সবমিলিয়ে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, যে রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে দাবি করা হচ্ছে যে বাংলাদেশের জুলাই-অগস্টে কোনও সাম্প্রদায়িক হিংসা বা মৃত্যু হয়নি, সেই রিপোর্টেই হিংসা ও মৃত্যুর কথা উল্লেখ রয়েছে।
আরও পড়ুন:- আঙুর শুধু জলে ধুলেই হয় না, ৩ উপায়ে পরিষ্কার না করলে মারণ রোগের বাসা বাঁধবে