বিস্ফোরণ বা ভূমিকম্পেও কাঁপবে না বাড়ি ! আসানসোলের ছাত্রছাত্রীদের চমক

By Bangla News Dunia Desk Bappaditya

Published on:

Bangla News Dunia, বাপ্পাদিত্য:- খোলামুখ কিংবা ভূগর্ভস্থ খনি থেকে কয়লা উত্তোলনে ডিনামাইটের বিস্ফোরণ নতুন কিছু নয়। সেই বিস্ফোরণের জেরে প্রায়শই কেঁপে ওঠে মাটি, ফাটল ধরে খনি এলাকার বাড়ির দেওয়ালে। এবার চৌম্বক ক্ষেত্রের বিকর্ষণ ধর্মকে কাজে লাগিয়ে আসানসোল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এমন এক অভিনব বাড়ির মডেল তৈরি করেছে; যার ব্যবহারে শুধু যে এই ধরণের ফাটল ধরা রোধ করা সম্ভব তা নয়, ভূমিকম্পেও নিরাপদ থাকবে বাড়ির কাঠামো।

দেশের স্বার্থে মাটির তলার খনিজ উত্তোলন করতেই হয়, সেক্ষেত্রে বাসিন্দাদের পুনর্বাসন দেওয়ার প্রকল্প রয়েছে । কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদী। তাই বাসিন্দাদের সুরক্ষিত রেখে কয়লা উত্তোলন কীভাবে করা যায় তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছেই । আর সেখানেই চমকে দিল আসানসোল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একদল ছাত্রছাত্রী । চৌম্বক ক্ষেত্রের বিকর্ষণ ধর্মকে কাজে লাগিয়ে বাড়ির মডেল বানিয়ে ছাত্রছাত্রীদের দাবি, খনি এলাকায় যদি এই বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বাড়ি বানানো হয়, তবে সেই বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না । কারণ মাটির কম্পন বাড়ির উপর পর্যন্ত পৌঁছবে না । সে কারণে বাড়িটি নিরাপদ থাকবে । তবে শুধু খনি এলাকা নয়, ভূমিকম্পেও বাড়িটি নিরাপদ থাকবে বলে ছাত্রছাত্রীদের দাবি ।

খনি এলাকায় কীভাবে বিপদ আসে

খনি এলাকায় হঠাৎই ডিনামাইটের শব্দ শুনে বা কম্পন অনুভব করে যেকোনও মানুষ ভাবতে পারেন, ভূমিকম্প হল । খনি এলাকায় বিস্ফোরণে তীব্র কম্পন ও ধসের ফলে বাড়ি ধসে যাওয়া, বাড়িতে ফাটল একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা । আসানসোল, রানিগঞ্জ এলাকায় প্রায় 140টি মৌজা ধস কবলিত । বহু বাড়ি এই ধসের ফলে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে । বহু জনপদ বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে । খোলামুখ খনি বা ভূগর্ভস্থ খনিতে বিস্ফোরণে প্রতিদিনই বহু বাড়িতে ফাটল দেখা দেয় । ক্ষতিগ্রস্ত হয় বহু পাকাবাড়িও ।

Asansol Students Invent Magnetic House

ভূমিকম্পেও বাড়িটি নিরাপদ থাকবে বলে ছাত্রছাত্রীদের দাবি

 

বাসিন্দাদের পুনর্বাসন দিতে কেন্দ্রের ধস পূনর্বাসন প্রকল্প নিয়ে কাজ চলছে । কিন্তু খনি এলাকার এই বিস্ফোরণের জেরে বাড়িগুলির যে ক্ষতি হয়, তা রুখে দেওয়া সম্ভব । এমনটাই দাবি করছেন আসানসোল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইনফরমেশন টেকনোলজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের একদল ছাত্রছাত্রী । একটি বিশেষ বাড়ির মডেল বানিয়েছেন তাঁরা ।

আসানসোল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ভাবনা

আসানসোল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইনফরমেশন টেকনোলজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা ‘ব্লুপ্রিন্ট উইজার্ড’ নামে একটি টিম গঠন করেছে । মূলত 10 জন ছাত্রছাত্রী এই টিমের সদস্য, যারা নতুন কিছু আবিষ্কার করার নেশায় মশগুল । এই টিমেরই টিম লিডার মহম্মদ আরসালান মুস্তাকের নেতৃত্বে একটি অন্যরকম বাড়ি তৈরি করার ভাবনা শুরু হয় ।

Asansol Students Invent Magnetic House

মাটির কম্পন বাড়ির উপর পর্যন্ত পৌঁছবে না

 

মূলত খনি এলাকায় কিংবা ভূমিকম্প বিধ্বস্ত এলাকায় এই বাড়িটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হবে বলে ছাত্রছাত্রীদের দাবি । টিম ব্লুপ্রিন্ট উইজার্ডের সদস্য অর্পিতা সাউ, আরশাদ জামিল আর্সালান, শ্রেয়সী বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রেয়া কুমারী সাউ ও আরকুম ফয়জল এই বাড়িটির মডেল তৈরি করেছেন । সম্প্রতি আসানসোল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে একটি মডেল প্রদর্শনীতে এই বাড়িটি প্রদর্শিত হয় ৷ প্রত্যেকেই তারিফ করেছেন ছাত্রছাত্রীদের এই ভাবনার।

কীভাবে এই বাড়ি তৈরি করা হবে

ছাত্রছাত্রীরা জানাচ্ছেন, এই বাড়ির তলায় যে পিলারগুলি ব্যবহার করা হবে, সেগুলির একেবারে নিচের অংশে মাটির সংস্পর্শে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন একটি চুম্বক রাখা হবে । একইভাবে মধ্য অংশ ফাঁকা রেখে একই মেরুর আরেকটি চুম্বক তার উপর ব্যালান্স করা হবে । সেই চুম্বকের উপর থেকে উঠবে আরেকটি পিলার । দু’টি চুম্বক একই মেরুতে মুখোমুখি হওয়ায় একে অন্যকে বিকর্ষিত করবে। ফলে বাড়িটি প্রায় ভাসমান অবস্থায় থাকবে । অর্থাৎ মাটির কম্পন বাড়ির উপরে পৌঁছবে না ।

Asansol Students Invent Magnetic House

চৌম্বক ক্ষেত্রের বিকর্ষণ ধর্মকে কাজে লাগিয়ে এই বাড়ির মডেলটি তাঁরা বানিয়েছে

 

কীভাবে এই বিজ্ঞান কাজ করবে ?

ছাত্রছাত্রীরা জানাচ্ছেন, যখন দু’টি চুম্বককে পরস্পরের কাছে আনা হয়, তাদের ক্ষেত্রগুলি পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া তৈরি করে । এই মিথস্ক্রিয়াই আসলে আকর্ষণ বা বিকর্ষণের মূল কারণ । বিজ্ঞান বলে, চুম্বকের বিপরীত মেরুগুলি একে অন্যের কাছে এলে, তাদের ক্ষেত্রগুলি একে অন্যকে আকর্ষণ করে । অন্যদিকে, চুম্বকের একই মেরু মুখোমুখি বা কাছাকাছি এলে তাদের ক্ষেত্রগুলি পরস্পরকে বিকর্ষণ করে । এক্ষেত্রেও সেই বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে একই ক্ষেত্রের চুম্বককে কাছাকাছি নিয়ে আসা হবে । সেক্ষেত্রে একে অপরকে বিপরীতে মুখে ঠেলবে । পিলারের তলায় এমনভাবে চুম্বক লাগাতে পারলে কম্পন আর উপরে উঠবে না । ফলে বাড়িটি সুরক্ষিত থাকবে ।

আরও পড়ুন:- হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক নওশাদ সিদ্দিকীর, জানুন কী কথা হল?

কী বলছেন ছাত্রছাত্রীরা ?

আসানসোল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রী শ্রেয়া কুমারী সাউ, অর্পিতা সাউ বলেন, ‘‘আমরা এই বিশেষ ধরনের বাড়িটি বানিয়েছি । খনি এলাকায় বিস্ফোরণের পরে যে সমস্ত বাড়িগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিংবা ভূমিকম্পের ফলে যে বাড়িগুলিতে ফাটল ধরে, সেই বাড়িগুলি রক্ষা পাবে এই বিজ্ঞানকে কাজে লাগালে । আমরা মডেলের মাধ্যমে দেখিয়েছি, নীচের তলায় কম্পন হলেও উপরতলায় সেই কম্পন পৌঁছচ্ছে না । কম্পনের দ্বারা যে আলো জ্বলে, সেই ডিটেক্টর লাগিয়ে আমরা প্রমাণ করেছি যে নীচের অংশে কম্পন হলেও বাড়ির উপরে সেই আলো জ্বলছে না । অর্থাৎ বৈজ্ঞানিকভাবে এই বাড়ির মডেলটি সত্য । যদি চৌম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করে তাদের বিপরীত বিকর্ষণ ক্ষমতাকে কাজে লাগানো যায়, তাহলে মাটির তলার কম্পন উপরে পৌঁছবে না এবং বাড়িটি সুরক্ষিত থাকবে ।

Asansol Students Invent Magnetic House

শুধু খনি এলাকা নয়, ভূমিকম্পেও বাড়িটি নিরাপদ থাকবে বলে ছাত্রছাত্রীদের দাবি

 

কী বলছেন শিক্ষক ?

আসানসোল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষক তথা কলেজের হার্ডওভার ক্লাবের পরিচালক সৌমেন সেন জানিয়েছেন, ‘‘ছাত্রছাত্রীদের এই প্রয়াস সত্যিই অভূতপূর্ব । তাঁরা যে এটা ভেবেছে, এটাই খুব ভালো লাগছে । পাশাপাশি তাঁরা মডেল তৈরি করে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করেছে, এরকম বাড়ি বানানো সম্ভব । আগামিদিনে মডেলটি আমরা পেটেন্টের জন্য পাঠাব এবং চাইব সরকার এটার উপর হস্তক্ষেপ করুক । যাতে এই বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আগামিদিনে বাড়ি তৈরি করলে, অনেক মানুষই নিরাপদ এবং সুরক্ষিত থাকতে পারবেন ।

আসানসোল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আরেক শিক্ষক তথা কলেজের হার্ডওয়ার ক্লাবের আরেক পরিচালক বিপ্লব ভৌমিক বলেন, ‘‘ছাত্রছাত্রীরা যে প্রোটোটাইপ মডেলটি তৈরি করেছে সেটি একটি ইনোভেটিভ মডেল হয়েছে ৷ আমরা খুব আশাবাদী বিষয়টাকে নিয়ে । আগামিদিনে আমরা যদি কিছু ফান্ডিং পাই, তাহলে সেটা আমরা প্রোটোটাইপ থেকে একটা বাস্তবিক পরীক্ষালব্ধ মডেলের দিকে এগোতে পারব । সেই কারণে কোনও অর্গানাইজেশন কিংবা কোনও সংস্থা বা সরকারিভাবে কেউ যদি এগিয়ে আসেন তাহলে এই মডেলটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব ।’’

অন্যদিকে আসানসোলের বিশিষ্ট আর্কিটেকচার সোহম মুখোপাধ্যায় জানান, ‘‘ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের পড়াশোনার ফাঁকে যে মডেল তৈরি করেছেন সেটা এক কথায় অভাবনীয় । তবে বাস্তবক্ষেত্রে এমন বাড়ি বানানো খুব একটা সহজ কাজ নয় । তার কারণ হচ্ছে বিভিন্ন বাড়ির নির্মাণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ম থাকে ৷ খনি এলাকা ছাড়াও বাড়িতে অত্যধিক ওজন হলে ফাটল হয় । আসবাব বা অনেক কিছুর জন্য বাড়ির উপর চাপ বাড়ে এবং সেখান থেকেও ফাটল দেখা দিয়েছে বড় বড় বহুতলগুলিতে । সুতরাং এভাবে ম্যাগনেটিক ফিল্ডকে ব্যবহার করলেই যে বাড়িতে ফাটল ধরবে না বা নিচের স্তরের কম্পন উপরে পৌঁছবে না, বিষয়টি নিয়ে এখনই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যাবে না । পরীক্ষালব্ধভাবে আরও অনেক কিছু দেখার প্রয়োজন । কারণ ম্যাগনেটিক ফিল্ড ব্যবহার করলে বাড়িটির ব্যালান্স কেমন থাকবে, বাড়ির উপর ওজন বাড়লে, সেই ফিল্ড কতটা সেই ব্যালান্স রাখবে সবটাই দেখার বিষয় । তবে ছাত্রছাত্রীদের চিন্তা-ভাবনাকে অবশ্যই কুর্নিশ জানাই ।’’

আরও পড়ুন:- আপনার শিশুও কি পট্যাটো চিপসের ভক্ত? অবশ্য়ই জেনে রাখুন এই জিনিস

আরও পড়ুন:- হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি পূরণ করতে পাতে রাখুন এই ফলগুলি

 

Bangla News Dunia Desk Bappaditya

মন্তব্য করুন