সাফল্যের শীর্ষে থেকেও অবসাদের অতলে ! রাস্তা দেখালেন মনোবিদ

By Bangla News Dunia Desk Bappaditya

Published on:

Bangla News Dunia, বাপ্পাদিত্য:- পেশায় ইন্দো-আমেরিকান সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মী । প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনী । অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের মাস মাইনেও ছিল ঈর্ষণীয় । আপাতদৃষ্টিতে যে যে ‘বেঞ্চমার্ক’ সাফল্যের নিদান লেখে, সমস্ত প্যারামিটারই ছুঁয়ে ফেলেছিলেন তিনি ৷ তা সত্ত্বেও নিজেকে শেষ করে দেওয়ার পথ বেছে নিয়েছেন জনপ্রিয় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় বড়কর্তা ৷ মৃত্যুর প্রকৃত কারণ তদন্তাধীন হলেও পুলিশের প্রাথমিক অনুমাণ, এর পেছনে রয়েছে অবসাদ ৷

বিভিন্ন সূত্রে খবর, ঘটনার দিন নাকি তাঁকে বেশ ‘বিমর্ষ’ দেখাচ্ছিল । দীর্ঘদিন ধরেই ডিপ্রেসনে ভুগছিলেন তিনি, নিচ্ছিলেন মনোবিদদের পরামর্শ, খাচ্ছিলেন ওষুধ—এই সমস্ত তথ্যও সামনে এসেছে । কলকাতার নিউটাউনের অফিসের বহুতল থেকে পড়ে যান তিনি । সঙ্গে সঙ্গেই রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় । সেখানেই তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা । কিন্তু কেন ? সফল কর্মজীবন, সামাজিকক্ষেত্রে ‘পিরামিডের’ শীর্ষে থাকা দ্বৈপায়ন কেন নিজেকে শেষ করে দিলেন ? পারিবারিক সমস্যা না অন্য কোনও কারণ ?

মনোবিদ অনন্যা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এই অবসাদ শব্দটা আমরা এখন খুব ব্যবহার করি ৷ কোনও বাচ্চাও কিছু একটা জিনিস না-পেলেই বলে ডিপ্রেসড হয়ে যাচ্ছি ৷ ডিপ্রেসন এই শব্দটা আমরা যখন তখন ব্যবহার করি ৷ বেশ কিছু সময় শব্দটা আমরা না-বুঝেই বলে থাকি ৷ অবসাদ নিয়ে আমাদের যতটা চিন্তাভাবনা, সেটাই মনে করাবে একটা ঘটনা ৷ কয়েকবছর আগে সুশান্ত সিং রাজপুতের ঘটনার পর চারপাশ যেন নড়ে গিয়েছিল ৷ এই অবসাদ সাইলেন্ট কিলার ৷ শুধুমাত্র অর্থ, নাম, যশ থাকলেই যে অবসাদ হবে না, সেটা নয় ৷ একজন মা’ও সন্তান প্রসবের পর ডিপ্রেসড হতে পারেন ৷ এর নাম পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন (Postpartum Depression) ৷ সুতরাং অবসাদ হওয়ার জন্য যে উচ্চ কেরিয়ার নেই বা ভালো উপার্জন নেই, তা নয় ৷ অনেক সময় কারণ ছাড়াই অবসাদ আসে, আমরা বুঝতেও পারি না ৷ ডিপ্রেসন থেকে শুরু করে মনখারাপ, সমস্ত কিছুর জন্য আমাদের ইন্টারনাল বডি অর্থাৎ আমাদের শরীরের কিছু হরমোনও দায়ী হতে পারে ৷ সেই হরমোন উপর-নীচ করার ফলে অনেক কারণ তৈরি হয় ৷ একটা অবসাদের লক্ষণ কী সেটাই আমরা বুঝতে পারি না ৷ আমরা ভাবি মনখারাপ মানেই অবসাদ ৷’’

আরও পড়ুন:- বাড়িতে উইন্ডো এসি লাগাবেন নাকি স্প্লিট এসি? কিভাবে বুঝবেন, জানুন

dwaipayan Bhattacherjee Mental health

মনোবিদ অনন্যা ভট্টাচার্য

বিষণ্ণতা এমন একটি রোগ যা মন এবং শরীর উভয়কেই প্রভাবিত করে । সমীক্ষা বলছে, বিশ্বব্যাপী 30 কোটিরও বেশি মানুষ বিষণ্ণতার সঙ্গে বসবাস করছে ৷ যা 2005 থেকে 2015 সালের মধ্যে 18% এরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুসারে, 5 কোটি 60 লক্ষ, অর্থাৎ 4.5% ভারতীয় বিষণ্ণতায় ভুগছেন ৷ আরও 3 কোটি 80 লক্ষ, অর্থাৎ 3.5% ভারতীয় উদ্বেগজনিত ব্যাধিতে ভুগছেন ।

মনোবিদ আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বলেন, ‘‘ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেসনের আগে ভাবতে হবে, আমাদের কি কোনও বর্ডারলাইন ডিপ্রেসন (Borderline depression) আছে ? মানুষের মধ্যে সবার এই বর্ডারলাইন ডিপ্রেসন থাকে ৷ কোনও কিছু হল না, তার জন্য মনখারাপ ৷ বা কেউ মারা গেলেন, তারজন্য় শোক ৷ এগুলি চলতেই থাকে ৷ এই অবস্থায় আমরা অনেকসময় এই ডিপ্রেসনের মধ্যে দিয়ে যাই, আবার কম সময়ের মধ্যে ফিরেও আসা যায় ৷’’

আরও পড়ুন:- ঘুমের সঙ্গে রয়েছে ক্যানসারের যোগ ! কি জানালেন চিকিৎসক ?

ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেসন কখন হয় ?

‘‘অনেকদিন ধরে ভালোলাগার জিনিসও ভালো না-লাগতে শুরু করবে ৷ যেমন কেউ গান শুনতে ভালোবাসেন, আবার কেউ শপিং বা সিনেমা দেখা ৷ কিন্তু বহুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, সেটা আর করতে ইচ্ছা করছে না ৷ সামাজিক কোনও সমাবেশে গিয়েও কথা বলতে ইচ্ছা করছে না ৷ হঠাৎ করে চুপ হয়ে গিয়েছে ৷ হঠাৎ করে ক্ষণে ক্ষণে কান্না আসছে ৷ কেন আসছে তার কারণ জানা নেই ৷ হঠাৎ করে মনে হয় দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে ৷ এগুলি ছাড়াও দেখা যায়, খিদে কমে আসা অথবা বেড়ে যাওয়া ৷ এছাড়াও ওজন বেড়ে যাচ্ছে বা কমে যাচ্ছে ৷ ঘুমের সমস্যা হওয়া ৷ তার মধ্যে অন্যতম, ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গিয়ে শুয়ে থাকতে না-পারা ৷ প্রচণ্ড অস্বস্থিবোধ, ঘরে আলো সহ্য করা যায় না ৷ এনার্জি একদম কমে যাওয়া এগুলির সঙ্গে সঙ্গে সেক্সচুয়াল এনার্জি সেটা হঠাৎ করে ডাউন হয়ে যাওয়া ৷ এই লক্ষণগুলি ক্রমাগত বাড়তে থাকলে তখন দেখা যায় সুইসাইডাল থট আসছে ৷ অর্থাৎ অনবরত মনে হচ্ছে, নিজেকে শেষ করে দিই ৷ এরকমও কোনও কারণ থাকে না, ব্যক্তিগত জীবনে অশান্তি বা কাজের জায়গায় টানাপোড়েন ৷ হঠাৎ করেই মনে হয়, সব পাওয়া হয়ে গিয়েছে ৷ বেঁচে থেকে করব কী ? যে কারণে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেসন মারাত্মক হয় ৷’’

‘Environmental Abuses’ কী কী ভাবে হতে পারে ?

অনন্যা বলেন, ‘‘এটা সুইসাইডাল প্রেসার হতে পারে ৷ সাম্প্রতিককালে এক ঘটনা সামনে এসেছিল ৷ একজন শিক্ষিকা আত্মহত্যা করেছেন ৷ তিনি তাঁর স্বামীকে উদ্দেশ্য করে লিখে গিয়েছেন, ‘আমি যথেষ্ট উপার্জন করি ৷ কিন্তু আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন কাজের লোকের মতো করে আমার থেকে কাজ নেওয়ার কথা ভাবেন ৷ আমি একজন শিক্ষিকা ৷ ফলে আমার পক্ষে এই প্রেসার নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না ৷’’

মনোবিদ বলেন, ‘‘আজ দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে আমরা শুনেছি, আগেই তাঁর কিছু সমস্যা ছিল ৷ যার চিকিৎসা চলছিল ৷ এছাড়াও তিনি একজন বড় একটি সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মী ছিলেন ৷ নামের পাশে উচ্চপদ লেখা থাকলে, তার প্রেসারও কোন মারাত্মক জায়গায় পৌঁছয়, অনেকেই সেটা বুঝতে পারেন না ৷ তাই কোথাও গিয়ে ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্সের জায়গাটা পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যায় ৷ এটা নিয়েও যে খুব একটা মাথাব্যথা হচ্ছে, এমন নয় ৷ বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থায় সিএসআরের (Corporate Social Responsibility) প্রোগ্রাম হয় ৷ কারণ সিএসআর প্রোগ্রামটা দেখাতে হয় ৷ কিন্তু তার অ্যাপ্লিকেশন কতটা হয় সেটা এখনও প্রশ্নের মুখে ৷ দেখানোর জন্য প্রোগ্রাম করা ও সারাবছর সেটা নিয়ে কাজ করা দু’টো আলাদা জিনিস ৷’’

আইটি সেগমেন্টে আরও একটা জিনিস হয়েছে, আপনার যদি কোনও মানসিক সমস্যা হয় তার জন্য আপনি কাউন্সেলিং করাতে পারেন ৷ অফিস থেকেই তাঁর কনট্যাক্ট দেওয়া হবে ৷

তিনি বলেন, ‘‘যখন একটা মানুষের ডিপ্রেসন হয়, তখন অনেক ক্ষেত্রেই তিনি বা বাকিরা তা বুঝতে পারেন না ৷ আমার কাছে একজন এসেছিলেন, তিনি একজন প্রফেশনাল খেলোয়াড় ৷ তিনি বুঝতেই পারেননি তাঁর ভিতরে এমনভাবে ডিপ্রেসন দানা বেঁধেছে যে তাঁর জীবনের প্যাশন, খেলাও ছেড়ে দিতে চাইছেন ৷ এর সঙ্গে তাঁর সুইসাইডাল আইডিয়া আসছে ৷ তাই মানুষ তখন বুঝতেই পারেন না সমস্য়া কখন হচ্ছে ৷ এই কিছু কিছু ফাঁক মানুষের জীবনে ভয়ংকরভাবে ধরা দিচ্ছে ৷ যা মানুষকে গ্রাস করছে ৷’’

এছাড়াও আরও একটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে, মাতৃত্বকালীন অবসাদ ৷ এটা নিয়ে অনেকে মাথা ঘামান না ৷ বাচ্চা হয়ে যাওয়ার আগে যে কেয়ার কমফোর্ট ও ভালোলাগা বা ভালোবাসার যে জায়গাটা থাকে, মা হয়ে যাওয়ার পর পুরোপুরি শিফট হয়ে যায় বাচ্চার উপরে ৷ মা হয়ে যাওয়া মানে সব স্যাক্রিফাইস করা এটা নয় ৷ অনেকক্ষেত্রেই মায়ের ভালোলাগা বা খারাপ লাগাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না ৷ এই পরিস্থিতি একটা সমস্যার আকার ধারণ করে ৷ পরবর্তীকালে তা ভয়ংকর রূপ নেয় ৷

তিনি জানান, কিছুদিন আগেও আরও একটি ঘটনা সামনে এসেছে ৷ মা তার বাচ্চাকে খুন করেছে ৷ কারণ, সে ঘুমাতে পারত না ৷ এটাও একটা মাতৃত্ত্বকালীন অবসাদ ৷ এর জন্য একটা গবেষণা করা হয়েছিল ৷ একজন ব্যক্তিকে না-ঘুমাতে দিয়ে টানা জাগিয়ে রাখা হয়েছিল ৷ এই গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, 48 ঘণ্টা সময় কাটার পর কিছু অস্বাভাবিক অবসাদ ও 72 ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর তা আরও বেড়েছে ৷ এইভাবে যতটা সময় পেড়িয়েছে একটা সময়ের পর প্রচণ্ড অ্যাগ্রেসিভ হয়ে উঠেছে ৷ তাই এটা স্বাভাবিক একজন মানুষের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো ভীষণভাবে জরুরি ৷ এই প্রত্যেক ঘটনার কতগুলি দিক আছে একটা শারীরিক ও একটা মানসিক এবং সামাজিক ৷

পজিটিভ ফ্যান্টাসি কিংবা ইতিবাচক আনন্দ বোঝানোর প্রবণতা কতখানি কমে গেলে সতর্ক হওয়া যায় ?

মনোবিদ বলেন, “সাইকোলজির ভাষায় একটা কথা আছে Insight ৷ যেখানে যেটা হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি ৷ পরবর্তীতে Insight যত লো হতে থাকে তত মনে হয় এটা আমার হচ্ছে অন্য কারও জন্য ৷ সুতরাং তার ঠিক হওয়াটা দরকার আমার নয় ৷ তৃতীয়ত যখন মনে হয় আমার কিছু হচ্ছেই না ৷ একটু অসুবিধা হচ্ছে আমি ম্যানেজ করে নিতে পারবো ৷ আরও যখন ইনসাইট লো হয় তখন মনে হয় এইসব আমার হচ্ছেই না এই ভুল জিনিস আমাকে বলা হচ্ছে ৷ সুতরাং ইনসাইড লো এর সঙ্গে সুইসাডের কোনও যোগাযোগ নেই ৷ সমস্যা হল আমাদের যে মূহুর্তে হ্যাপি হরমোন ডাউন হচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ভিতরকার যে কষ্ট যেটা আমরা ফিল করছি সেটার যে হরমোন উপরদিকে উঠছে ইনক্রিজ করছে তখন ধীরে ধীরেই আমাদের মধ্যে বোধগুলি তৈরি হতে শুরু করে ৷”

মনোবিদ জানান, আত্মহত্যার আগে প্রায় সকলেই একটা সংকেত দিয়ে যান । আর সেই সংকেত ধরা থাকে মুখের কথায় । নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে অস্বস্তির কথা একবার না একবার বলে যান তাঁরা । তখন বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে ‘ও কিছু হবে না, এগুলি তেমন কিছু নয়’—বলাটা ডেকে আনতে পারে বড় বিপদ ৷

নিজেকে শেষ করে দেওয়া কোনও সমাধান নয় ! যদি আপনার আত্মহত্যার চিন্তা আসে, অথবা আপনার কোনও বন্ধুর জন্য চিন্তিত হন অথবা আপনার মানসিক সহায়তার প্রয়োজন হয়, তাহলে অনেকে আপনার কথা শোনার জন্য প্রস্তুত । যেকোনও সমস্যায় স্নেহা ফাউন্ডেশন – 04424640050 (24×7 উপলব্ধ) অথবা আইকল, টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সেস – 9152987821 নম্বরে কল করুন ৷ (সোমবার থেকে শনিবার, সকাল 8টা থেকে রাত 10টা পর্যন্ত খোলা থাকে)

(বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই প্রতিবেদনে উল্লেখিত তথ্য শুধুমাত্র ধারণা আর সাধারণ জ্ঞানের জন্যই লেখা হয়েছে ৷ এখানে উল্লেখিত কোনও পরামর্শ অনুসরণের আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন ৷ যদি আগে থেকেই কোনও স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে থাকে, তা আগেই চিকিৎসককে জানাতে হবে ৷)

আরও পড়ুন:- পথ দুর্ঘটনায় সাহায্য করতে কি এগিয়ে আসেন বাংলার মানুষ? জানুন সমীক্ষা কি বলছে

Bangla News Dunia Desk Bappaditya

মন্তব্য করুন