লন্ডন-বার্লিনে প্রশংসিত, গ্রামের বাড়িতে ম্যাজিক মিউজিয়াম তৈরি সেলিমের

By Bangla News Dunia Desk Bappaditya

Published on:

Bangla News Dunia, বাপ্পাদিত্য:- কলকাতার ভারতীয় জাদুঘর দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে, নিজের গ্রামে আস্ত একটা মিউজিয়াম তৈরির শখ হয়েছিল । 50 বছর ধরে প্রায় 12 হাজার দুষ্প্রাপ্য জিনিস সংগ্রহ করে সেই স্বপ্নকেই সযত্নে লালন করে চলেছেন সেলিম খোন্দকর ৷ ভাইঝি ওহিদার সহায়তায় সেই স্বপ্নই এবার সফল হওয়ার পথে ৷

হুগলির পুরশুরার প্রত্যন্ত গ্রাম কেলেপাড়ার বাসিন্দা 70 বছরের সেলিম খোন্দকর ৷ একটা সময়ে কর্মসূত্রে কলকাতায় এক চিকিৎসকের সহযোগী হিসাবে কাজ করতেন । তখনই মিউজিয়াম ও মেলা থেকে পুরনো দুষ্প্রাপ্য জিনিস সংগ্রহের প্রতি আগ্রহ বাড়ে তাঁর । কলকাতায় থেকে 50 বছর ধরে দেশি-বিদেশি রুপোর কয়েন, স্ট্যাম্প, কার্ড, ক্যামেরা, ক্যাসেট, গ্রামোফোন-সহ বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করেছেন । আগামী দিনে নিজের গ্রামে তাঁর সংগ্রহ নিয়ে মিউজিয়াম করতে চান সেলিম । তাঁর স্বপ্ন পূরণের চেষ্টায় নিরলস কাজ করে চলেছেন তাঁর ভাইঝি ওহিদা খোন্দকর ৷

করোনাকালে সেলিমকে নিয়ে ওহিদা তৈরি করেছেন তথ্যচিত্র । সেটাই জার্মানি, লন্ডন ও অস্ট্রেলিয়ার মিউজিয়ামে সম্মানিত হয়েছে । ইতিমধ্যে মিলেছে ঐতিহ্যবাহী জামিল পুরস্কার । আগামী দিনে সৌদি ও দুবাইয়েও যাবে এই তথ্যচিত্র । তবে এবার বড় তথ্যচিত্র ও 360 ডিগ্রি অ্যানিমিটেড ম্যাজিক মিউজিয়াম তৈরি করবেন ওহিদা । কাকার স্বপ্নকে সফল করাই তাঁর স্বপ্ন । কেলেপাড়া গ্রামে মিউজিয়াম করারও চিন্তাভাবনা রয়েছে তাঁর । ভাইঝির হাত ধরেই মিউজিয়াম তৈরির আশায় দিন গুনছেন সত্তরোর্ধ্ব সেলিম ।

ETV BHARAT

লন্ডন, বার্লিন-সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রশংসিত তাঁর প্রচেষ্টা 

 

মুঘল আমলের রুপোর কয়েন থেকে বিভিন্ন বিদেশি মুদ্রা, পোস্টাল স্ট্যাম্প, কার্ড, গ্রামোফোন রেডিয়ো-সহ নানা ধরনের দুষ্প্রাপ্য জিনিস রয়েছে সেলিমের সংগ্রহে ৷ তাঁর এই সফর শুরু হয়েছিল 1970 সালে ৷ এক চিকিৎসকের সহযোগী হিসেবে কাজ করার জন্য গ্রাম থেকে তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায় ৷ সেখানেই ভারতীয় জাদুঘরের বিরাট সম্ভার দেখে তাঁর পুরনো জিনিস সংগ্রহের নেশা ধরে ৷ গোটা সপ্তাহ কলকাতায় থেকে জিপিও ও বিভিন্ন বাজার থেকে তিনি নানা প্রাচীন জিনিস সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন গ্রামের বাড়িতে ৷ পুরনো মাটির বাড়ির রান্নাঘরে সব জমা করা থাকত ৷

ETV BHARAT

তাঁর কাছে রয়েছে বিভিন্ন বিদেশি মুদ্রা

 

এখনও পর্যন্ত প্রায় 12 হাজার রকমের মূল্যবান প্রাচীন জিনিসপত্র রয়েছে তাঁর সংগ্রহে । আগামী দিনে সেই সব দিয়েই মিউজিয়াম তৈরি করতে চান সেলিম । তবে ইচ্ছে থাকলেও এর জন্য প্রয়োজন বিপুল অর্থ ৷ ইতিমধ্যেই তাঁর সংগ্রহের বেশকিছু জিনিস, বইপত্র নষ্টও হয়ে গিয়েছে ৷ তাই কাকার সাধ পূরণে এগিয়ে এসেছেন তাঁর ভাইঝি ওহিদা ৷

 

 

বর্তমানে তিনি রয়েছেন নেদারল্যান্ডসে ৷ সেখান থেকেই ওহিদা বলেন, “50 বছর ধরে আমার চাচা এই বহু পুরনো জিনিসপত্র সংগ্রহ করে আসছেন । অনেকের কাছে হয়তো এর কোনও গুরুত্ব নেই । কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম । আমি একজন ফাইন আর্টসের শিল্পী হিসাবে এর গুরুত্ব বুঝেছিলাম । করোনার সময়ে গৃহবন্দি থাকাকালীন চাচার সংগ্রহ নিয়ে কিছু করা যায় কি না, এই বিষয়টি আমার মাথায় আসে ৷ বাড়ির মধ্যে স্তূপাকার হওয়া জিনিস নিয়েই তথ্যচিত্র তৈরি করার কথা ভাবি ৷ সেখান থেকেই তৈরি হয় ‘ড্রিম ইয়োর মিউজিয়াম’৷”

ETV BHARAT

50 বছর ধরে সংগ্রহ করে চলেছেন দুষ্প্রাপ্য জিনিস 

 

তিনি আরও জানান, “লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে তথ্যচিত্রটি ও পুরনো জিনিস তুলে ধরা হয় । এছাড়াও জার্মানিতে প্রদর্শনী করা হয় । বিদেশে ছাড়াও কলকাতার ইমামি মিউজিয়াম ও দেশের বিভিন্ন রাজ্যে তথ্যচিত্রটি দেখানো হচ্ছে । 2024 সালে জামিল পুরস্কার পায় এই তথ্যচিত্র । সেই আর্থিক অনুদান ও বিদেশি ফান্ড থেকে আগামী দিনে পুরশুরায় কেলেপাড়ার বাড়িতে একটি মিউজিয়াম করার চিন্তাভাবনা আছে । কলকাতার মিউজিয়াম যাঁদের দেখার সুযোগ হয় না, তাঁদের জন্য গ্রামেই একটি গ্রামীণ মিউজিয়াম করার ইচ্ছা রয়েছে । বর্তমানে চাচার সংগ্রহ নিয়ে 60 মিনিটের ‘মিউজিয়াম অন দ্য মুন’ তথ্যচিত্র বানাচ্ছি । যা বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পাঠানো হবে । এছাড়াও ইন্টারনেটের জগতে অ্যানিমেটেড 360 ডিগ্রি ম্যাজিক মিউজিয়াম তৈরি করেছি । যাতে গোটা বিশ্বের মানুষ চাচার এই সংগ্রহ দেখতে পায় ।”

 

ভাইঝির চেষ্টাতেই এতদিনকার ইচ্ছে পূরণের আশায় রয়েছেন সেলিম খোন্দকর ৷ তিনি বলেন, “আগামী দিনে গ্রামোফোন রেকর্ড, টেপ ও রেডিয়ো, বিভিন্ন বই, খবরের কাগজ-সহ আরও অনেক কিছু যাতে সাজিয়ে রাখতে পারি, বা মিউজিয়াম করতে পারি, এটাই আমার ইচ্ছা । আমার কাছে এক-দেড়শো বছর আগের আরবিতে লেখা এটা চিনামাটির প্লেট, মুঘল আমলের কয়েন রয়েছে । এছাড়াও ভুটান, বাংলাদেশ, নেপাল, আমেরিকার কয়েন সংগ্রহ করেছি । সম্পূর্ণ একক চেষ্টায় এগুলো সংগ্রহ করেছি 1970 সাল থেকে ।”

আরও পড়ুন:- পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনকে সেকেন্ডের মধ্যে…, কোন হুঁশিয়ারি দিলেন মোদির মন্ত্রী ?

 

 

ETV BHARAT

তাঁর সংগ্রহে রয়েছে বেশকিছু বহু পুরনো ক্যামেরা 

 

আর্থিক ও পারিবারিক বাধা ছিল ৷ তবে কোনও কিছুই সেলিমের সংগ্রহের নেশায় লাগাম পরাতে পারেনি ৷ তাঁর কথায়, “মিউজিয়াম করতে আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন । যদি সরকারিভাবে আর্থিক সাহায্য পাওয়া যায় তো ভালো, না-হলে অন্য কিছু চিন্তাভাবনা রয়েছে । আমার আর্থিক সচ্ছলতা সেভাবে ছিল না । তা সত্বেও মল্লিক বাজার, কলেজ স্ট্রিট থেকে বিভিন্ন রকম বই সংগ্রহ করি । অনেক সময় পরিবার থেকে আপত্তি এসেছে ৷ কিন্তু তারপরেও সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় অল্প বেতনের মধ্যেই এই সংগ্রহ চালিয়ে গিয়েছি । এত বছরের পুরনো জিনিস কিনতে আমার অনেক টাকা খরচ হয়েছে । কিন্তু কোনওদিনই সেই টাকার হিসেব করিনি । করোনার পর থেকে নিয়মিত কলকাতায় কাজ করতে যাওয়া এখন বন্ধ । মাঝে মধ্যে যাই । তবে সংগ্রহ করা থামাইনি ৷ এগুলো সাজিয়ে গ্রাম্য মিউজিয়াম করার ইচ্ছে রয়েছে ।”

 

ETV BHARAT

গ্রামের বাড়িতে ম্যাজিক মিউজিয়াম তৈরির স্বপ্ন সেলিমের 

 

সেলিমের ছেলে মোমেন খোন্দকরও স্বীকার করে নিলেন, বাবার এই নেশা দেখে অনেক সময় বিরক্ত হয়েছেন ৷ তবে আজ তিনিও নিজের চোখে এঁকে নিয়েছেন বাবার স্বপ্ন ৷ মোমেনের কথায়, “ছোটবেলা থেকেই বাবাকে বই ও বিভিন্ন জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে দেখেছি । তার গুরুত্ব বুঝতাম না ৷ সেগুলি নিয়ে খেলা করতাম । আগে অনেক সময় আমরা বিরক্ত হতাম । কারণ আমাদের মাটির বাড়িতে থাকারই জায়গা ছিল না । তার মধ্যে বাবা এত জিনিসপত্র এনে জমা করত, তাতেই বিরক্ত হয়ে যেতাম । এখন বাবার স্বপ্ন সফল হচ্ছে, এটা দেখে ভালো লাগছে ।”

 

তিনি আরও বলেন, “এগুলি সংগ্রহ করার কোনও চিন্তাভাবনা ছিল না আমাদের মধ্যে । আমার কাকার মেয়ে ওহিদা ফাইন আর্টস নিয়ে পড়াশোনা করেছে । সে এখন প্রতিষ্ঠিত । সে-ই বোঝায়, পুরনো জিনিস দিয়ে কিছু করা যায় ৷ তার পর থেকেই বাবার সংগ্রহের জিনিসের মিউজিয়াম করার স্বপ্ন দেখছি আমরা । বোন ওহিদা তথ্যচিত্র বানিয়ে জার্মানির বার্লিনে ও পরে লন্ডনের অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে দেখায় । তার জন্য 2024 সালে জামিল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে সে । একটা মিউজিয়াম দেখতে মানুষ শহরে ছুটে যায় । গ্রামেও সে রকম মিউজিয়াম করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে । সরকারি বা বেসরকারিভাবে যদি মানুষ এগিয়ে আসেন, তাহলে বাবার এই ভাবনা অন্য মাত্রা পাবে ৷”

ETV BHARAT

লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে সেলিমের সংগ্রহের ছবি (নিজস্ব চিত্র)

উল্লেখ্য, পুরশুরার কেলেপাড়ার আরেক বাসিন্দা পল্লব সরকারও নিজের উদ্যোগে সেলিমের মতো পুরনো জিনিস সংগ্রহ শুরু করেছেন । গত চার বছরে তাঁর সংগ্রহে এসেছে কিছু কয়েন, পোস্টকার্ড, রেকর্ড, ক্যাসেট ও মোবাইল-সহ বিভিন্ন জিনিস । তিনি বলেন, “সেলিম খোন্দকরের ব্যাপারে সেভাবে জানতাম না । শুধুমাত্র নিজের শখ থেকেই আগামী দিনে সমস্ত জিনিসপত্র দিয়ে মিউজিয়াম করার ইচ্ছা রয়েছে ।”

Bangla News Dunia Desk Bappaditya

মন্তব্য করুন