Bangla News Dunia, বাপ্পাদিত্য:- তাঁর পাখির চোখ যে বাংলায় ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচন, দুর্গাপুরের জনসভা থেকে তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৷ বাংলায় বক্তব্য শুরু, ‘রাম’ নামের বদলে ‘জয় মা কালী, জয় মা দুর্গা’, বেছে বেছে আরজি কর, কসবা কলেজ থেকে শুরু করে অনুপ্রবেশের মতো ইস্যুকে তুলে ধরে শাসকদলকে নিশানা করা – এই সবেরই পিছনে রাজনৈতিক কৌশল দেখছে তৃণমূল কংগ্রেস ৷ মোদির ভাষণকে ‘মিথ্যাচার’-এর তকমা দেওয়ার পাশাপাশি বাংলাভাষীদের উপর আক্রমণ ও মাছ-জিলিপি-সিঙাড়ার মতো বিষয়গুলি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীকে পালটা বিঁধেছে শাসকদল ৷ ভোটের মুখে মোদির ঘন ঘন বঙ্গ সফরকে কটাক্ষ করেছে সিপিআইএম ও কংগ্রেসও ৷
‘রামনামের বদলে ইউটার্ন করে জয় মা কালী, জয় মা দুর্গা’
2024 সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে দেশজুড়ে রামমন্দির উদ্বোধনের প্রচারে শামিল ছিলেন মোদি-শাহ থেকে শুরু করে রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্ব । বাংলায় ভোটপ্রচারে এসে একাধিকবার রামের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী । অথচ এবার, সেই রাম-নাম কার্যত উধাও । শুক্রবার দুর্গাপুরের সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বড়রা আমার প্রণাম নেবেন, ছোটরা ভালোবাসা । জয় মা কালী, জয় মা দুর্গা ।”
সাংবাদিক সম্মেলনে ফিশফ্রাই-সিঙাড়া-জিলিপি নিয়ে চন্দ্রিমা-কুণাল
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পরেই বিকেলে সাংবাদিক সম্মেলনে এই প্রসঙ্গ টেনে তাঁকে কড়া আক্রমণ করেন তৃণমূল নেতারা । রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূল মহিলা কংগ্রেস সভানেত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ অভিযোগ তোলেন, “বাংলায় এসে রামের নাম মুখে আনলেন না মোদি । তাহলে কি বঙ্গ বিজেপি এবার রামনাম ছেড়ে বঙ্গীয় দেবীবন্দনায় ঝুঁকছে ?”
এদিন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, “বাংলার সংস্কৃতিকে মাথায় রেখেই কি এই পরিবর্তন ? এতদিন যে রামনামে ভোট চাওয়া হচ্ছিল, আজ তার ছিটেফোঁটাও নেই । বাংলার মানুষ মাছ-মাংস খায়, জয় মা কালী বলেন, সেটা মাথায় রেখেই কি এই ইউটার্ন ?” চন্দ্রিমার কথায়, “বাংলায় এসে বাংলার প্রতি ভালোবাসার ভান করছেন মোদি, অথচ বাংলার ভাষা, সংস্কৃতির উপরে আঘাত আসে তাদেরই রাজ্য থেকে । এর উত্তর কোথায় ?”
তৃণমূলের কটাক্ষে ‘মাছ-মিষ্টি-অ্যান্ড-মোর’
এদিন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীন ‘অয়েল অ্যান্ড ফ্যাট বোর্ড’-এর নির্দেশিকার প্রসঙ্গ টেনে চন্দ্রিমা বলেন, “কে কী খাবে, সেটা গণতান্ত্রিক দেশে কেউ ঠিক করে দিতে পারে না । আমরা মাঝেমধ্যে নিরামিষ খাই, আবার আমিষও খাই । তৃণমূল কাউকে কোনওদিন খাওয়া নিয়ে ফতোয়া দেয়নি, বিজেপি বরং সেটা দেয় ।”
দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষও এবিষয়টি তুলে ধরে বলেন, “কে কী খাবেন, সেটা ব্যক্তিগত পছন্দ । কেউ নিরামিষ খাবেন নাকি আমিষ, তা ঠিক করার অধিকার কারও নেই । গণতান্ত্রিক দেশে এই ধরনের ফতোয়া মানা যায় না । আমরা তো পুজোর সময় নিরামিষ খাই, কিন্তু তাই বলে মাছ-মাংস খাওয়া যাবে না, এমন নির্দেশ চলবে না । মাছ-মিষ্টি-অ্যান্ড-মোর — এটাই বাংলার পরিচয় । আর সেই ঐতিহ্য থাকবেই, চলবেই ।”
কুণালের দাবি, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনওই মানুষ কী খাবেন তা নিয়ে হস্তক্ষেপ করেন না । বাংলার সংস্কৃতির উপর চাপিয়ে দেওয়া বিজেপির সংস্কৃতি এ রাজ্যে চলবে না । ফিশফ্রাই, সিঙাড়া, জিলিপির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেষ্টার আমরা বিরোধিতা করছি ।”
উল্লেখ্য, জনবহুল এলাকা বা ক্যাফেটেরিয়ায় পরিবেশিত খাবারে যদি ‘শারীরিক ঝুঁকি’ থাকে, তা হলে সতর্কবার্তা জুড়তে হবে । এই নির্দেশিকার প্রতিবাদে সরব হয়েছে তৃণমূল । দলের অভিযোগ, সিঙাড়া-জিলিপির মতো বাঙালির প্রিয় খাদ্যের উপর কেন্দ্র ফতোয়া জারি করেছে । খাবারের তালিকায় ‘বিপজ্জনক’ তকমা জুড়ে বাঙালির সংস্কৃতিকে অপমান করা হয়েছে বলেই অভিযোগ শাসকদলের । প্রতিবাদস্বরূপ এদিন সাংবাদিক সম্মেলনে ক্যামেরার সামনে সিঙাড়া, জিলিপি ও ফিশফ্রাই নিয়ে বসেছিলেন কুণাল ও চন্দ্রিমা ৷
‘মোদির ভাষণ মিথ্যাচার’
এদিন কুণাল ঘোষ মোদির ভাষণ ও প্রকল্পকে ‘মিথ্যাচার’ বলে অভিযোগ তোলেন । তাঁর কথায়, “1 লক্ষ 70 হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের দাবি করছেন, অথচ দৃশ্যমান কোথায় ? স্রেফ গল্পগুজব । 2014 সালে বছরে 2 কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি ছিল, 11 বছরে মাত্র 22 হাজার চাকরি হয়েছে — সংসদের স্থায়ী কমিটির রিপোর্টেই তা স্পষ্ট ।” তিনি আরও বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন নিয়ে বিজেপি বারবার মিথ্যাচার করে । কিন্তু প্রকৃত সত্য হল, বাংলার উন্নয়নের মডেলই এখন দেশের মধ্যে অন্যতম । বাংলায় আসছেন আর শুধু সমালোচনা করছেন, সেটা মানায় না ।”
নারী নির্যাতন নিয়েও এদিন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিকে কটাক্ষ করেন কুণাল । বলেন, “বাংলায় কোনও অপরাধ হলে 24 ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয় ৷ আরজি কর বা কসবার ঘটনার মতো । কিন্তু বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না । গুজরাত থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশ, কোথাও কি সরকার সজাগ ?”
রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও একই সুরে বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর মুখে বারবার মিথ্যে কথা । যাঁরা এখন বিজেপির মঞ্চে বসে আছেন, তাঁদের অনেকেই একদিন তৃণমূলের মুখ ছিলেন । এঁরা দলবদলু, যাঁদের দিয়ে কোনও পরিবর্তন হবে না । তৃণমূলের ছাঁটা লোকজন আজ বিজেপির ‘মডেল’। বাংলার মানুষ সব দেখেছেন, আর সেই কারণেই বিজেপি এ রাজ্যে 50টি আসনও পাবে না ।”
‘ডেলি প্যাসেঞ্জারি’ কটাক্ষ সুজনের
শাসকদলের পাশাপাশি দুর্গাপুরে প্রধানমন্ত্রীর এদিনের বক্তব্যের পালটা প্রতিক্রিয়া দিয়েছে সিপিআইএম ও কংগ্রেসও ৷ রাজ্য সরকারের পাশাপাশি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আঙুল তুলে সিপিআইএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, “রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্র ধ্বংস করা হচ্ছে এতে কোনও সন্দেহ নেই । কিন্তু দুর্নীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে ফেলা নিয়ে বলার অধিকার নেই প্রধানমন্ত্রীর । তাঁর নতুন শিক্ষানীতি বিপজ্জনক । গবেষণা বন্ধ দেশে । প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাহায্য করছে না সরকার । বাংলার শিল্পকে নষ্ট করে পাঠানো হয়েছিল গুজরাতে । এখন বাংলার ছেলেমেয়েরা পরিযায়ী, এই দায় তৃণমূল সরকারের । আবার ভিন রাজ্যে প্রতিদিন হেনস্তার মুখে পড়তে হচ্ছে বাংলার ছেলেমেয়েদের । তাঁদের বাপ-ঠাকুরদার কাগজ খুঁজে বের করা হচ্ছে । নানা রকম শারীরিক আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে । দিল্লির সরকার তাঁদের দেশছাড়া করার পরিকল্পনা নিচ্ছে ।”
কেন্দ্রের বিজেপি শাসিত সরকারের তীব্র সমালোচনা করে সুজন আরও বলেন, “একুশের নির্বাচনের আগে ঘন ঘন বাংলায় এসেছেন, হেলিকপ্টারে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছেন নরেন্দ্র মোদি । তাতে মানুষের মন ভেজেনি ৷ কারণ বাংলার মানুষ সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনায় চলে না । পাঁচ বছরে কিচ্ছু করেনি । এখন যা ঘোষণা সবটাই ভোটের দিকে তাকিয়ে । জয় শ্রীরাম, রামনবমী, হনুমান জয়ন্তী বা তৃণমূলের জগন্নাথ পুজো, বাংলার এটা কালচার নয় । এটা মানুষ গ্রহণ করছে না । তাই বিজেপিকে এখন জয় দুর্গা, জয় কালী বলতে হচ্ছে । কেন বলতে পারছে না এই দুই দল, যুবকের জয় হোক, কৃষকের জয় হোক, শ্রমিকের জয় হোক ।”
মোদিকে রাজধর্ম পালনের পরামর্শ কংগ্রেসের
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে কটাক্ষ করে তাঁকে একগুচ্ছ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে কংগ্রেসও ৷ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার বলেন, “বাংলা-সহ সারাদেশে ঘটা নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনাগুলি নিয়ে কংগ্রেস সরব ও প্রতিবাদে মুখর । কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে ঘটে চলা নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে চুপ কেন থাকেন ? নরেন্দ্র মোদি তো কেবল বিজেপির প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি তো দেশের প্রধানমন্ত্রী । আমাদের স্পষ্ট প্রশ্ন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকা সিবিআই ও ইডি কেন আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতির কোনও কিনারা করতে পারল না ? কেন আপনার সিবিআই আজ পর্যন্ত যোগ্য-অযোগ্য শিক্ষকদের চিহ্নিত করতে পারল না ? কেন সিবিআই-এর অপদার্থতার জন্য আরজি কর কাণ্ডের নির্যাতিতার পরিবার আজও সুবিচার পেল না ?”
কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের অপসারণের ডাক দিয়ে শুভঙ্কর বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে কংগ্রেস পথে নামে । কিন্তু বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, বিহারে যে জঙ্গলরাজ চলছে, মোদিজি তা নিয়ে কোনও কথা বলেন না কেন ? নির্বাচন এলেই মোদিজির বাংলার প্রতি দরদ উথলে ওঠে । কিন্তু বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের উপর যে নিগ্রহ চলছে, তা নিয়ে মোদিজি রাজধর্ম পালন না করে কংগ্রেসকে দোষারোপ করতে ব্যস্ত আজ !” শুভঙ্করের কথায়, “পশ্চিমবঙ্গকে বাঁচাতে যেমন এই তৃণমূল সরকারের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অপসারণ দরকার, ঠিক তেমনই গোটা দেশকে বাঁচাতে এই বিজেপি-আরএসএস-এর সরকারের অপসারণ আশু প্রয়োজন ।”
আগে পহেলগাঁও সামলান, মোদিকে পালটা কুণালের
এদিন দুর্গাপুরে আসার আগে বিহারের সভা মঞ্চ থেকে বাংলার পর্যটন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যকেও এদিন একহাত নেয় তৃণমূল ৷ জলপাইগুড়িকে জয়পুর ও বীরভূমকে বেঙ্গালুরুর মতো উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি । তাঁর এই মন্তব্যের পালটা জবাব দিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলায় পর্যটক নিহত হওয়ার ঘটনা মনে করে দিয়েছেন কুণাল ঘোষ ।
তিনি বলেন, “পর্যটন নিয়ে যদি কেউ বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রথম ভাবেন, তিনি হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । পাহাড়, ডুয়ার্স, সুন্দরবন, সমুদ্রতট, জঙ্গলমহল, গৌড়বঙ্গ থেকে রাঢ়বঙ্গ — সব জায়গাতেই উন্নয়নের ছোঁয়া পড়েছে । একসময় যেখানে বাম আমলে কেউ যেতে চাইতেন না, আজ সেগুলো পর্যটকদের পছন্দের গন্তব্য ।”
প্রধানমন্ত্রীকে নিশানা করে কুণালের খোঁচা, “আপনার কি জলপাইগুড়ি সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে ? কতগুলি নতুন ডেস্টিনেশন তৈরি হয়েছে জানেন ? কোনও হোমওয়ার্ক না করেই বক্তৃতা দিতে উঠে পড়েছেন । আর বীরভূমের কথা আপনি বলছেন ? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন, তারাপীঠ, কৃষি ও ধর্মীয় পর্যটনের কেন্দ্র—সবই তো এই জেলায় । বীরভূমও নিজস্ব ছন্দে এগোচ্ছে । আপনাদের থেকে আমরা সেটা শুনব কেন ?”
সবশেষে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে কুণালের চাঁচাছোলা মন্তব্য, “আপনি আগে পহেলগাঁও সামলান । যেখানে পর্যটকদের পাহারা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে কেন্দ্রীয় প্রশাসন । জঙ্গিরা ঢুকে মেরে যাচ্ছে নিরীহ মানুষদের । ওটা সামলান আগে । বাংলার পর্যটনের দেখভালের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যথেষ্ট আছেন ।”
আরও পড়ুন:- পতঞ্জলির শেয়ার কেনা আছে? তাহলে সুখবর আছে, জেনে নিন
আরও পড়ুন:- ভিড় সামাল দিতে অতিরিক্ত লোকাল চলবে শিয়ালদা শাখায়, কোন রুটে কত ট্রেন ? জেনে নিন