Bangla News Dunia Desk : ভারতের ইতিহাসে ফের এক বিতর্কিত অধ্যায়ের সূচনা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সদ্য জারি করা গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, দেশের প্রতিটি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে বাধ্যতামূলকভাবে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করতে হবে। জানা যায়, এর পেছনে রয়েছে সদ্য প্রণীত ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ফরেনার্স অ্যাক্ট, ২০২৫, যা পুরোপুরি কার্যকর হবে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের পর থেকে। এখন প্রশ্ন উঠছে, সত্যিই কি এর প্রয়োজন ছিল? নাকি এটি এক বৃহৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হতে চলেছে ?
নতুন আইন: ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ফরেনার্স অ্যাক্ট ২০২৫ কী বলছে?
১৯৬৪ সালের ফরেনার্স অর্ডার বাতিল করে এই নতুন আইনটি আনা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। এই আইন অনুসারে, যারা ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪-এর মধ্যে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারতে প্রবেশ করেছেন, কিংবা ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে—তাদের সবাইকে “অবৈধ বিদেশি নাগরিক” হিসেবে গণ্য করা হবে। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং তারা ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক থাকবেন যতক্ষণ না দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে তাদের।
বিশেষ ছাড় শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য
তবে এখানে আইনে একটি ব্যতিক্রম রাখা হয়েছে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকেরা যারা ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে ভারতে এসেছেন—তাদের জন্য নির্বাসন থেকে ছাড় দেওয়া হতে পারে। অর্থাৎ মুসলিম বা অন্য ধর্মাবলম্বী অবৈধ অভিবাসীদের ক্ষেত্রে কোনও রকম সহানুভূতির জায়গা রাখা হয়নি এই আইনে।
এই সিদ্ধান্ত নিয়েই মূলত সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি হয়েছে গোটা দেশে। এদিলে অনেকেই বলছেন, এটি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের ওপর সরাসরি আঘাত ফেলে।
ট্রাইবুনাল: বিচারের জন্য আলাদা কাঠামো
নতুন আইনে বলা হয়েছে, প্রত্যেক রাজ্যে তিন সদস্যের ট্রাইবুনাল গঠন করা হতে চলেছে, তারা সন্দেহভাজন কোনও বিদেশি নাগরিককে চিহ্নিত করে তার ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করার নির্দেশ দেবে। যদি তিনি প্রমাণে ব্যর্থ হয়ে থাকেন, তাহলে ট্রাইবুনাল ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর নির্দেশ দিতে পারবে বলে জানানো হয়। আশ্চর্যজনকভাবে বলা যায়, জেলা প্রশাসন বা রাজ্য সরকার এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না।
এখানে প্রশ্ন উঠেছে—এই ট্রাইবুনাল কতটা স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং মানবিক ভাবে হবে? ভারতের মত বহুত্ববাদী রাষ্ট্রে এই ধরনের বিচার ব্যবস্থা আদৌ কতটা গ্রহণযোগ্য হবে?
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া: বিরোধী দলগুলির তীব্র সমালোচনা
এই ঘোষণার পরপরই বিরোধী দলগুলির তীব্র প্রতিক্রিয়া সামনে আসে। তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস, AAP সহ একাধিক দল একে ‘গণতন্ত্রের ওপর আঘাত’ বলে উল্লেখ দিয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্টভাবে বলেন, “ভারতবাসীদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে এই আইন এনেছে। বাংলায় কোনও ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হতে দেওয়া যাবে না।”
মানবাধিকার সংস্থার উদ্বেগ
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা Amnesty India, Human Rights Watch, UNHRC—এই তিনটি সংস্থাই ইতিমধ্যেই ভারত সরকারের পদক্ষেপকে “Concern of Discrimination” হিসেবে চিহ্নিত করেছে বলে রিপোর্ট। তাদের মতে, এটি একটি স্পষ্ট রকমের Targeted Detention System, যা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে চলেছে এবং আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের মানবিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে জানানো হয়।
সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ
ইতিমধ্যে অসম, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বহু দরিদ্র ও অশিক্ষিত মানুষ, যাদের কাগজপত্র ঠিকঠাক নেই, তারা ভয় পাচ্ছেন এই আইন তাদের ওপরও প্রয়োগ হতে পারে বলে। এমনকি ভারতের বহু প্রকৃত নাগরিকও এখন নথিপত্র হালনাগাদ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
ডিজিটাল নজরদারি বাড়ছে
নতুন গেজেট বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, প্রতিটি বিদেশীর ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ফেস স্ক্যান বাধ্যতামূলক হতে চলেছে। এই ডেটাগুলি একটি কেন্দ্রীয় সার্ভারে জমা রাখা হবে। এর মাধ্যমে সরকারের উদ্দেশ্য হলো—প্রতিটি বিদেশী নাগরিকের গতিবিধি ও অবস্থান ট্র্যাক করতে হবে। অন্যদিকে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এই ধরণের নজরদারি ভবিষ্যতে ভারতীয় নাগরিকদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ হতে পারে।