Primary Teachers Judgment: কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর এজলাসে ৩২,০০০ প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিল মামলা নিয়ে যে চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হয়েছে, তা নিয়ে রাজ্যজুড়ে জোর চর্চা চলছে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি সাধারণ ধারণা—আদালত কি তবে শুধুমাত্র মানবিকতার খাতিরে বা দীর্ঘ ৯ বছর চাকরি করার সুবাদে এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষকের জীবিকা রক্ষা করল? অনেকেই মনে করছেন, মানবিকতাই ছিল এই রায়ের মূল ভিত্তি। কিন্তু রায়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিষয়টি মোটেও এতটা সরলরৈখিক নয়। মানবিকতার স্পর্শ থাকলেও, এই ঐতিহাসিক রায়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে সুদৃঢ় আইনি যুক্তি এবং কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা বা সিবিআই-এর রিপোর্টের ওপর।
বিচারপতি তাঁর রায়ে স্পষ্ট করেছেন যে, শুধুমাত্র আবেগের বশবর্তী হয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। বরং সিবিআই-এর তদন্তে উঠে আসা তথ্য এবং আইনি নজিরগুলোই এই মামলায় শিক্ষকদের পক্ষে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সিবিআই রিপোর্টের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
এই মামলার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে মূলত সিবিআই-এর পেশ করা তদন্ত রিপোর্ট। দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ ছিল যে, এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে এবং বাইরের কোনও সংস্থার মাধ্যমে বেআইনিভাবে সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু সিবিআই-এর রিপোর্টে উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র:
- বোর্ডের প্রত্যক্ষ ভূমিকা: তদন্তকারী সংস্থা জানিয়েছে, নিয়োগের সুপারিশপত্র বা রেকমেন্ডেশন খোদ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ বা বোর্ড থেকেই দেওয়া হয়েছিল। এর ভিত্তিতেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ইস্যু করা হয়।
- থার্ড পার্টির অনুপস্থিতি: এস. রায়বসু কোম্পানির মতো কোনও তৃতীয় পক্ষের বা থার্ড পার্টি এজেন্সির মাধ্যমে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি, যা বিরোধীদের অন্যতম প্রধান অভিযোগ ছিল।
- ব্যাপক দুর্নীতির প্রমাণ নেই: সিবিআই এমন কোনও প্রমাণ দাখিল করতে পারেনি যা নির্দেশ করে যে ৩২,০০০ জন প্রার্থীর প্রত্যেকেই অসৎ উপায় অবলম্বন করে চাকরি পেয়েছেন। অর্থাৎ, ‘সিস্টেমেটিক ফ্রড’ বা পুরো সিস্টেম জুড়ে জালিয়াতির তত্ত্ব এখানে ধোপে টেকেনি।
চিহ্নিত অনিয়ম ও আদালতের পর্যবেক্ষণ
আদালত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছে যে, গুটিকয়েক অনিয়মের জন্য পুরো নিয়োগ প্যানেল বাতিল করা আইনত সঠিক নয়। সিবিআই তদন্তে নির্দিষ্ট কিছু প্রার্থীর ক্ষেত্রে অনিয়ম খুঁজে পাওয়া গেছে, যাদের সংখ্যা মূল নিয়োগের তুলনায় নগণ্য। তদন্তে উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে অনিয়মগুলিকে আদালত নির্দিষ্ট ভাগে ভাগ করেছে।
নিচে একটি সারণীর মাধ্যমে চিহ্নিত অনিয়মগুলো তুলে ধরা হলো:
| প্রার্থীর সংখ্যা | অনিয়মের ধরন |
|---|---|
| ২৬৪ জন | বেআইনিভাবে গ্রেস মার্কস বা বাড়তি নম্বর দেওয়া হয়েছিল। |
| ৯৬ জন | টেট পরীক্ষায় প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জনকারী নম্বর (Qualifying Marks) পাননি। |
বিচারপতি পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, যেহেতু ‘দুষ্ট গরুর’ মতো নির্দিষ্ট অযোগ্য প্রার্থীদের (২৬৪ ও ৯৬ জন) আলাদা বা ‘সেগ্রেগেট’ করা সম্ভব হয়েছে, তাই ভালো ও যোগ্য প্রার্থীদের শাস্তি দেওয়া অনুচিত। এই নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রার্থীর বাইরে বাকিদের নিয়োগে দুর্নীতির কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলেনি।
মানবিকতা বনাম আইনি যুক্তি: আসল সত্য কী?
জনমানসে যে ধারণা তৈরি হয়েছে যে ৯ বছর চাকরি করার জন্যই আদালত নমনীয় হয়েছে, তা আংশিক সত্য মাত্র। রায়ে বলা হয়েছে, এই শিক্ষকরা ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নিযুক্ত হয়েছিলেন, আর চিহ্নিত অনিয়মগুলো ঘটেছিল একই বছরের নভেম্বর মাসে। অর্থাৎ সময়ের নিরিখেও দুটি ঘটনা ভিন্ন।
চাকরি জীবনে এই শিক্ষকদের সততা (Integrity) বা দক্ষতা (Efficiency) নিয়ে গত এক দশকে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। ইন্টারভিউ বোর্ডে পরীক্ষকদের প্রভাবিত করা বা ঘুষ দেওয়ার মতো সুনির্দিষ্ট প্রমাণও সিবিআই দিতে পারেনি। একাডেমিক স্কোর কম থাকা সত্ত্বেও ইন্টারভিউ বা অ্যাপটিটিউড টেস্টে ভালো নম্বর পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই শুধুমাত্র নম্বরের তারতম্য দেখিয়ে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াকে কলুষিত বলা যায় না।
পরিশেষে বলা যায়, মানবিকতা অবশ্যই বিচারকের মনে কাজ করেছে, বিশেষ করে দীর্ঘ সময় ধরে চাকরি করা এবং শিক্ষকদের পরিবারের কথা ভেবে। কিন্তু সেই মানবিকতা এসেছে আইনি যুক্তির পরিপূরক হিসেবে। মূল রায়টি দাঁড়িয়ে আছে সিবিআই-এর রিপোর্টে ‘সিস্টেমেটিক ফ্রড’ প্রমাণ না হওয়া এবং অযোগ্যদের চিহ্নিত করতে পারার আইনি সাফল্যের ওপর।














