Bangla News Dunia, বাপ্পাদিত্য:- ‘বাজারে চাকরি নেই’, ‘স্যালারি কম’, ‘ভালো চাকরি করতে হলে বেঙ্গালুরু, দিল্লি, পুনেই ভরসা’, ‘ওয়ার্কপ্লেসের পরিবেশ ভালো নয়’— কম বয়সিদের মুখে প্রায়শই এ সব কথা শোনা যায়। কম বয়সি বলতে, যারা সদ্য চাকরি জীবনে পা রেখেছেন। আরও ভেঙে বললে যা দাঁড়ায়, তা হলো জেন জ়ি। ২০২৫-এ দাঁড়িয়ে যাদের বয়স খুব বেশি হলে মাত্র আঠাশ। কর্মজীবনের গাড়ি টপ গিয়ারে পৌঁছনোর আগেই তাদের হাজারো অভিযোগ। কিন্তু নতুন এমপ্লয়ি হিসেবে এই প্রজন্ম কেমন?
কোভিডের সময়ে বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। ঠিক সেই সময়ে ‘ওয়ার্কফোর্স’-এ যোগ দেয় জেন জ়ি-রা। প্রথম চাকরি। নতুন কেরিয়ার। তার উপর ওয়ার্ক ফ্রম হোম। সব মিলিয়ে একদম টানটান উত্তেজনা। কিন্তু এই ‘এক্সসাইটমেন্ট’ কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে আর রইল না। সদ্য কলেজ পাস করা জেন জ়ি-দের যাঁরা চাকরি দিয়েছিলেন, কর্পোরেট দুনিয়ায় যাঁরা এইচআর, তাঁদের অনেকেই এখন কপাল চাপড়াচ্ছেন। বলছেন, ‘ভুল হয়ে গিয়েছে’। সেই ভুলের খেসারত দিতে গিয়ে চাকরি থেকে বরাখস্ত করছেন জেন জ়ি-দের একাংশকে। কর্মক্ষেত্রে এই প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করা বেশ চ্যালেঞ্জের বলে মনে করছেন ‘কর্পোরেট এমপ্লয়ি’রা।
২০২৩ সালে রেজ়ুমে বিল্ডারের করা একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ৭৪% ম্যানেজার ও বিজ়নেস লিডার জানিয়েছেন, জেন জ়ি-দের সঙ্গে কাজ করা বেশ কঠিন। অফিসের পরিবেশের সঙ্গে এই প্রজন্ম নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। অনেকের অভিযোগ, ‘প্রফেশনালিজ়ম’ নেই জেন জ়ি-দের একাংশের মধ্যে। এদের ‘কমিউনিকেশন স্কিল’ নেই। এরা অফিসে ‘ডেকোরাম’, ‘প্রোটোকল’ মেনে চলতে পারে না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ম্যানেজার অন্য প্রজন্মের এবং তাঁর সঙ্গে মতের অমিল লেগেই থাকে। তার উপর জেন জ়ি বিশ্বাস করে ‘ওয়ার্ক লাইফ ব্যালান্স’, ‘মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট’-এ। কাজের চেয়ে ‘পারফেক্ট’ লাইফস্টাইল বজায় রাখায় বেশি বিশ্বাসী জেন জ়ি।
এ ব্যাপারে প্যাটন ইন্ডিয়ার এমডি সঞ্জয় বুধিয়ার মন্তব্য, ‘নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে বা জেন জ়ি-দের মধ্যে খুব দ্রুত সাফল্য লাভের চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। সাফল্যের যে কোনও শর্টকাট হয় না, এটা তাঁরা ভুলে গিয়েছেন বা জানেন না। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, লিফ্টে যেমন দ্রুত উপরে ওঠা যায়, তেমনি তাড়াতাড়ি নিচেও নামা যায়। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তাদের চাকরি জীবনের গোড়ার কথা এবং সেই সময় কাকে বা কাদের পাশে পেয়েছে, তা মনে রাখার প্রয়োজন মনে করে না। অথচ, যে সহজ সাফল্যের পিছনে দৌড়োয়, সেই সাফল্যও অধরা থাকে। যা মানসিক অবসাদের দিকে তাঁদের ঠেলে দিচ্ছে।’
ম্যানেজার, টিম লিডার, এইচআর-দের বক্তব্য অনুযায়ী, জেন জ়ি-রা একদমই পেশাদার নন। কাজের প্রতি নিষ্ঠা নেই। এমনকি এই প্রজন্মের মধ্যে ‘মোটিভেশন’-এর অভাব। প্রায় ৪৬ শতাংশ জেন জ়ি কাজের জায়গায় পেশাদারিত্ব দেখায় না। শুধু তা-ই নয়, এই প্রজন্মের অর্ধেকের বেশি মানুষের কর্মজীবনের শুরু লকডাউনে। অর্থাৎ শুরু থেকেই ওয়ার্ক ফ্রম হোম। তাই কর্পোরেট কালচারের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতেও এদের সমস্যা। সিনিয়রদের দাবি, এই প্রজন্মের অধিকাংশ ছেলেমেয়ের বিদ্যাই পুঁথিগত। হাতে-কলমে কাজ করার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নেই। তাই ‘রিয়েল ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ক’ করতে গিয়ে ভ্যাবা-চ্যাকা খাচ্ছেন অনেকে।
জিনিয়াস কনস্যালটেন্টের সিএমডি আরপি যাদবের কথায়, ‘মিলেনিয়াল ও জেন জ়ি — কাজের সূত্রে এই দুই প্রজন্মের সঙ্গেই আমার প্রতিনিয়ত ওঠাবসা। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, দুই প্রজন্মেরই কাজ নিয়ে যে প্রত্যাশা এবং কাজ করার মানসিকতা, দু’টোই আলাদা। যেখানে মিলেনিয়ালরা কনস্ট্রাকটিভ ফিডব্যাক ও মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেশনের মাধ্যমে লং-টার্ম কেরিয়ার লক্ষ্যের কথা ভাবে, সেখানেই জেন জ়ি-রা সহজ ও চটজলদি সমাধানের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এগিয়ে যেতে চায়।
’আরও পড়ুন:– অজানা উপসর্গে পরপর ১৭ মৃত্যু, নমুনায় বিষের হদিশ, কী হচ্ছে কাশ্মীরের এই গ্রামে?
অভিযোগের তালিকা এখানেই শেষ নয়। এইচআর-দের দাবি, এই প্রজন্মের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে ইন্টারভিউয়ের দিন সময় মতো অফিসে এসে হাজির হতে পারে না। কেউ কেউ একেবারেই আসে না এবং আবার অনেকে কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই ইন্টারভিউ দিতে চলে আসে, ফলত উত্তীর্ণ হতে পারে না। যদি হাতে অফার লেটার চলে আসে, জয়েনিংয়ের দিন তারা আসে না এবং সেটা কর্তৃপক্ষকে জানানোরও প্রয়োজন বোধ করে না। এমন ওয়ার্কপ্লেস কালচারকে আবার জেন জ়ি ডাকে ‘ক্যাটফিশিং’ নামে।
জেন জ়ি স্মার্ট ওয়ার্কে বিশ্বাসী। দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে ‘এআই’। কোড লেখার জন্য রয়েছে ChatGPT, মেইল লিখতে সাহায্য করছে grammarly-র মতো সাইট। সুতরাং, খুব বেশি মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পড়ছে না। তা ছাড়া এই প্রজন্মের কাছে কেরিয়ার অপশনও অনেক। সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার থেকে মেশিন লার্নিং — এমন সব পেশা বেছেই ‘লাইফ’ বানাচ্ছে জেন জ়ি। এই প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করতে হলে কোম্পানিগুলোকেও তাদের কাজের ধরন বদলাতে হবে বলে মনে করছেন একাধিক সিনিয়র কর্পোরেট এমপ্লয়ি।
আরপি যাদবের ব্যাখ্যা, ‘ডিজিটাল ট্রানজ়িশনটা মিলেনিয়ালরা দেখেছে। কিন্তু জেন জ়ি-রা দ্রুত কমিউনিকেশন পছন্দ করে। কাজের জায়গায় যে সিনিয়রের সঙ্গে কোনও জটিল সম্পর্ক চায় না, কাজের জায়গায় যেন স্বাধীনতা থাকে এবং ফেক্সিবল ও হাইব্রিড সলিউশন, ফেক্সিবল কেরিয়ার চায়। তারা সহকর্মীর তুলনায় ডিজিটাল লার্নিংয়ের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল।’ তাঁর সংযোজন, ‘এই প্রজন্ম এমপ্লয়ির স্বাস্থ্য, কর্মক্ষেত্রে বৈচিত্র্য ও ওয়ার্ক লাইফ ব্যালান্সের উপর গুরুত্ব দেয়। এই বিষয়গুলো সংস্থার উন্নতির জন্যও জরুরি। সুতরাং, সংস্থাগুলোকেও মতামতের পার্থক্য বুঝে কাজের জায়গা ও ওয়ার্কপ্লেস কালচারে পরিবর্তন আনতে হবে।’ এই উন্নতি অফিসে সব বয়সের এমপ্লয়ির জন্যই উপকারী হবে।
জেন জ়ি-দের একাংশ ঝুঁকছে স্টার্ট আপ-এর দিকে। Santander UK-এর করা এক সমীক্ষা বলছে, জেন জ়ি-রা ৯-৫টার চাকরি করতে চায় না। ‘নিজেই নিজের বস’ — এই থিওরিতে বিশ্বাসী। ৭৬ শতাংশ জেন জ়ি কারও অধীনে চাকরি করতে নারাজ। ৭৭ শতাংশ জেন জ়ি-র আত্মবিশ্বাস এতটাই, যে, সে নিজের ব্যবসা শুরু করতে পারবে বলে মনে করে। সেটাও ‘সাকসেসফুল’ ভাবে। ডিজিটাল যুগে নিজের ব্যবসা শুরু করা সেই অর্থে আর মোটেই কঠিন কাজ নয়। কিন্তু কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে জেন জ়ি নিজেকে কেন খাপ খাওয়াতে পারছেন না, কিংবা ‘অ্যাডজাস্ট’ কেন করছেন না, সেটাই প্রশ্নের।
আরও পড়ুন:– আপনার আধার কার্ড কি অন্য় কোথাও ব্যবহার হচ্ছে! কী করে বুঝবেন? এক ক্লিকে দেখে নিন