Bangla News Dunia, বাপ্পাদিত্য:- অমর্ত্য সেন তখন সবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়েছেন। অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, ভারত সম্পর্কে কথা বলছিলেন তাঁর সঙ্গে। আচমকা অমর্ত্যকে তিনি বলেন, “তার মানে আপনি ডঃ মনমোহন সিং-এর দেশের লোক।” বিশ্বের তাবড় অর্থনীতিবিদদের কাছে এভাবেই পরিচিত ছিলেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী।
রাজনীতির গবেষকরা ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের মূলত দু’টি ভাগে ভাগ করে থাকেন। দেশ বিভিন্ন সময় এমন ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পেয়েছে, যিনি পদে আসার আগেই নিজেকে এক নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় নিয়ে যেতে পেরেছেন। আবার কেউ কেউ পদে থেকে নিজেদের যোগ্যতার বিচারে ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। লালবাহাদুর শাস্ত্রী থেকে শুরু করে মনমোহন সিং, অনেকেই এই দ্বিতীয় বিভাগের সদস্য হিসেবে পরিচিত।
মনমোহন সিং তথাকথিত রাজনীতিক নন। দীর্ঘসময় ছিলেন না রাজনীতিতেও। প্রথমে মেধাবী ছাত্র। পরবর্তী সময়ে প্রভাবশালাী আমলা। রাজনীতিতে আসার আগে এই ছিল তাঁর পরিচয়। । এরপর রাজনৈতিক জীবন। সরাসরি দেশের অর্থমন্ত্রী। আরও পরে বড় দায়িত্ব-প্রধানমন্ত্রিত্ব। শেষমেশ পরাজয় এবং চিরবিদায়।
ইতিহাসের শুরু
দেশকে শক্তপোক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর বসিয়ে দেওয়া মনমোহনের জন ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার। কখনও লোকসভা নির্বাচনে জেতাও হয়নি। 1999 সালে খোদ দিল্লি থেকে ভোটে লড়েন মনমোহন। পরাজিত হন বিজেপির প্রবীণ নেতা বিজয়কুমার মালহোত্রার কাছে। প্রায় 30 হাজার ভোটের বিরাট ব্যবধানে সেদিন দক্ষিণ দিল্লি আসনে পরাজিত হন সদ্যপ্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ।
তবে এখানেই ইতিহাসের শেষ নয় বরং শুরু। সেদিনের সেই পরাজিত নেতা পরবর্তী সময়ে টানা 10 বছর থেকেছেন প্রধানমন্ত্রীর আসনে। দেশের প্রথম অ-হিন্দু প্রধানমন্ত্রী। তিনি দেশের প্রথম অ-গান্ধি প্রধানমন্ত্রীও বটে, যিনি পরপর দু’বার বসেছেন ভারতের মসনদে।
ছোটবেলা
মনমোহন সিংয়ের জন্ম 1932 সালের 26 সেপ্টেম্বর, অধুনা পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশে। তাঁর কৈশরে ভাগ হল দেশ। বাবা গুরমুখ সিং ও মা অমৃত কৌরের সঙ্গে মনমোহন চলে এলেন অমৃতসরে। 1952 সালে পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ৷ দু’বছর বাদে পাশ করলেন স্নাতকোত্তর। এরপর পাড়ি দেন বিলেতে। 1957 সালে কেমব্রিজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক। আরও পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নফিল্ড কলেজ থেকে ডি’ফিল।
আমলা-জীবন
অক্সফোর্ড থেকে ফিরে ভারতে এসে যোগদান করেন রাষ্ট্রপুঞ্জে চাকরিতে। ছয়ের দশকের মধ্যভাগে রাষ্ট্রপুঞ্জের বাণিজ্য উন্নয়ন শাখায় কাজ করেন মনমোহন। একেবারে শেষের দিকে 1969 সালে শুরু করেন শিক্ষকতা। তবে তার মেয়াদ ছিল মাত্র তিন বছর। অর্থমন্ত্রকের মুখ্য উপদেষ্টার দায়িত্বে এলেন। আরও পরে 1976 সালে দেশের অর্থসচিব হন। এরপরের গন্তব্য যোজনা কমিশন। আটের দশকের একেবারে গোড়ায় 1982 রিজার্ভ ব্যাঙ্কে গভর্নর হিসেবে কাজ শুরু করেন। 1985 সাল থেকে 1987 সাল পর্যন্ত ছিলেন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সন। 1987 অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা স্বাধীন সংস্থা সাউথ কমিশনের মহাসচিব। জেনিভার সেই কাজ ছেড়ে দেশে ফিরে এসে হন ইউজিসি-র চেয়ারম্যান। এরপরই শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক জীবন।
অর্থমন্ত্রী
মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ-সহ নানা কারণে নয়ের দশকের গোড়ায় ভারতীয় অর্থনীতি এক কঠিন সময়ের মধ্যে যাচ্ছিল। সঙ্কট অবশ্য শুরু হয়ে গিয়েছিল তার কয়েক বছর আগেই। এমনই জটিল পরিস্থিতিতে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন পিভি নরসিমা রাও। সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে সাহিত্য এবং রাজনীতি ছিল তাঁর পছন্দের বিষয়। কিন্তু তখন দেশের দরকার এক নির্ভরযোগ্য অর্থমন্ত্রীর।
রাজনীতির অন্দরে কান পাতলে শোনা যায়, গান্ধি পরিবারের ঘনিষ্ঠ এক প্রাক্তন আমলা অর্থমন্ত্রী হিসেবে মনমোহনের নাম প্রস্তাব করেন। তখন তিনি ইউজিসি-র চেয়ারম্যান। মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের দু-একদিন আগে তাঁর কাছে অর্থমন্ত্রী হওয়া প্রস্তাব যায়। তবে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে কোনও বার্তা না আসায় ততক্ষণ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি মনমোহন।
শপথের সকালেও গিয়েছিলেন নিজের দফতরে। সেখানেই ফোন আসে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে। এতক্ষণে মনমোহন বিশ্বাস করেন তিনিই হতে চলেছেন দেশের পরবর্তী অর্থমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কাজ দেশ কখনও ভুলতে পারবে না। কঠিন আর্থিক পরিস্থিতির হাত থেকে রেহাই পেতে একমাত্র পথ যে উদার অর্থনীতি তা ভালোই বুঝেছিলেন তিনি। বিশ্বের দরবারে ভারতের বাজারকে উন্মুক্ত না-করা পর্যন্ত অর্থনীতিতে যে জোয়ার আসবে না, একথা তাঁর জানা ছিল। সেই কাজটাই করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী (2004-14)
ভারত-উদয়ের কথা বলে দেশজুড়ে প্রচার করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী থেকে শুরু করে লালকষ্ণ আদবানিরা। তাতেও 2004 সালের লোকসভা নির্বাচনে জেতা হয়নি বিজেপি’র। একা না পারলেও সঙ্গীদের নিয়ে সরকারে ফেরে কংগ্রেস। সব শরিককে নিয়ে চলতে পারবেন এমন নেতার খোঁজ শুরু হল কংগ্রেসে। শেষমেশ মনমোহনকেই বেছে নিলেন সোনিয়া গান্ধি।
মনমোহনের আগে দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটল বিহারী। রাজনৈতিক পরিসর যাঁর কাছে আসত আমলাতন্ত্রের আগে। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর ওএসডি (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) ব্রজেশ মিশ্রই বকলমে প্রধানমন্ত্রীর দফতর চালাতেন বলে আজও দাবি করে নানা মহল। এর ঠিক বিপরীত বিন্দুতে ছিলেন মনমোহন। আমলা বেশি, নেতা কম।
তবে তাঁকে যে কম রাজনৈতিক আক্রমণ সইতে হয়েছে তা মোটেই নয়।। একদিকে বিজেপির মতো বিরোধী দল অন্যদিকে জোট শরিক বামেরা- প্রায় প্রতিটি সময়ে রাজনীতির ছায়া প্রশাসনের উপর দীর্ঘ হয়ে থাকত। পাশাপাশি খোদ মনমোহনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। ঠিক সেই সময় ভারতীয় রাজনীতিতে একটি শব্দবন্ধ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল- ‘সুপার প্রাইমিনিস্টার’।
কংগ্রেস সভাপতি এবং ইউপিএর চেয়ারপার্সন হিসেবে নেপথ্যে থেকে সোনিয়া গান্ধি সরকার চালাতেন বলে অভিযোগ তোলে বিরোধীরা। গান্ধি পরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক যে নানা ঘাত–প্রতিঘাত অতিক্রম করেছে, তাও অস্বীকার করা যাবে না।
সিং ইজ কিং
তুমুল রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যেই দেশকে পারমাণবিক শক্তির দিকে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন মনমোহন। আমেরিকার সঙ্গে নিউক্লিয়ার বিল বা পারমাণবিক চুক্তি করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন মনমোহন । কংগ্রেসের একটা বড় অংশই আশঙ্কা করেছিল এমন চুক্তিতে বামেদের সমর্থন পাওয়া যাবে না। হলও তাই। কিন্তু শরিকদের আপত্তি মেনে পিছিয়ে আসতে রাজি হলেন না মনমোহন। ফল যা হওয়ার তাই। প্রথম ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করল বামেরা। কিন্তু সমাজবাদী পার্টি-সহ কয়েকটি দল সমর্থন করায় আস্থা ভোটে জিতে যায় মনমোহন সরকার। দলীয় সমর্থন ততটা না-পেয়েও সরকার বাঁচিয়ে তখন তিনিই ‘সিং ইজ কিং’। 2009 সালের লোকসভা নির্বাচন মনমোহনকে সামনে রেখেই লড়ে কংগ্রেস। তাতে সাম্প্রতিক অতীতে সবচেয়ে ভালো ফল হয় হাত শিবিরের।
শেষের শুরু…
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয় দফার শুরুটা তেমন ভালো হয়নি মনমোহনের। ঠিক এই সময় বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের নেতৃত্বে বড় পরিবর্তন দেখা দিতে থাকে। কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের কংগ্রেসের ফলাফল খারাপ হয়। এমনই পরিস্থিতিতে প্রথমে কমনওয়েলথ গেমস পরবর্তী সময়ে 2জি স্পেক্ট্রাম দুর্নীতির খবর প্রকাশ্যে আসে। সরকারের প্রধান হিসেবে সমস্ত সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠেন মনমোহন। পাশাপাশি দলের সঙ্গেও দূরত্ব বাড়তে থাকে প্রধানমন্ত্রীর।
অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ বিরোধীদের নতুন করে অক্সিজেন দেয়। দেশজুড়ে প্রতিবাদে নামে বিজেপি। আন্না হাজারের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনও চাপ বাড়ায় কংগ্রেসের। 2013 সালে অপরাধীদের নির্বাচনে লড়া নিয়ে অর্ডিন্যান্স পাশ করে মনমোহন-মন্ত্রিসভা।
দিল্লিতে প্রেসক্লাব অফ ইন্ডিয়ায় একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে অর্ডিন্যান্সের কপি ছিঁড়ে ফেলেন রাহুল গান্ধি। সেদিনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সময়ে শেষ হয়ে এসেছে মনমোহনের। কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরলেও তিনি যে আর প্রধানমন্ত্রী হবেন না, তা পরে প্রকাশ্যে জানিয়েও দেন নেতা।
নোটবন্দির ফলাফল
2016 সালে নোটবন্দি করে মোদি সরকার। রাতারাতি বাতিল হয়ে যায় পুরনো 500 ও 1000 টাকার নোট। প্রতিবাদে সরব হয় বিরোধী শিবির। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছিলেন এমন সিদ্ধান্ত আসলে ‘ছুরি দিয়ে গলা কাটা’র মতো। পাশাপাশি তাঁর মনে হয়েছিল, এভাবে নোটবন্দি করা আসলে একটি পরিকল্পিত অপরাধ যা দেশের অর্থনীতির জন্য বিপর্যয়ের বয়ে আনবে। পরবর্তী ক্ষেত্রে ভারতীয় অর্থনীতির উপর নোটবন্দির কুপ্রভাব নিয়ে বিস্তারিত চর্চা হয়েছে আর প্রতিবারই আলোচনা এসেছেন মনমোহন।
ইতিহাস এবং মনমোহনের মূল্যায়ন
বিরোধীদের কাছে তিনি ছিলেন মৌনি-মোহন। তাদের অভিযোগ ছিল, সরকার আসলে তিনি চালান না, চালান সোনিয়া গান্ধি। তিনি আদতে ছিলেন এক দুর্বল প্রধানমন্ত্রী। সংবাদমাধ্যমেও তাঁর প্রবল সমালোচনা হয়েছে। এমন সব প্রশ্নের মুখে মনমোহন একাধিকবার বলেছেন, “আশা করি ইতিহাস আমার প্রতি এখনকার সংবাদমাধ্যমের থেকে বেশি উদার হবে…” এই মন্তব্য থেকেই বোঝা যায়, মনে একরাশ আক্ষেপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব শেষ হয়েছিল মনমোহনের। সেই রেশ ধরেই শেষ হল এক মহাজীবনের। পরিসমাপ্তি হল ভারতীয় রাজনীতির এমন এক অধ্যায়ের, যা আজীবন থেকে গিয়েছে শ্বেতশুভ্র।