Bangla News Dunia, বাপ্পাদিত্য:- দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে বিগত ৬০ বছর ধরে নিবিড় চাষের উপর অত্যধিক নির্ভরতা ভারতীয় কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারকে বহু গুণ বাড়িয়েছে। ফলে দেখা দিয়েছে মাটির জৈব কার্বনের ঘাটতি, ভূগর্ভস্থ জলের অভাব। নষ্ট হয়েছে জমির উর্বরতা। এ ছাড়াও, কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক দূষণ বেড়েছে বহু গুণ। এই পরিস্থিতিতে, মাটির উর্বরতা বাড়িয়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে এবং গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন ঠেকাতে ‘কার্বন চাষ’-কে অন্যতম বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই চাষের বাড়তি সুবিধা, ভলান্টারি কার্বন মার্কেট বা ভিসিএম-এ কার্বন ক্রেডিট বিক্রি করে চাষিরা বাড়তি আয়ের সুযোগ পাবেন।
গত বছর ২৬ জুলাই ভারতের কৃষিমন্ত্রী রাজ্যসভায় জানিয়েছিলেন, দেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের কার্বন ক্রেডিটের সুবিধা পাইয়ে দিতে সরকার কৃষিক্ষেত্রের জন্য ভিসিএম-এর পরিকাঠামো গঠনে উদ্যোগী হয়েছে। এই ভিসিএম ফ্রেমওয়ার্কের প্রধান উদ্দেশ্য, কৃষকদের সুস্থায়ী কৃষিতে অনুপ্রাণিত করা এবং এ ব্যাপারে তাঁদের সচেতনতা এবং সক্ষমতা বাড়ানো।
কার্বন বাজার কী?
সহজ ভাষায়, কার্বন বাজার হল এমন একটি বাজার যেখানে কার্বন ক্রেডিট কেনাবেচা হয়। ধারণাটি একেবারেই নতুন নয়, কয়েক দশক ধরে চলে আসছে। ১৯৯৭ সালে কিয়োটো প্রোটোকল অনুযায়ী উন্নত দেশগুলিতে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ বাধ্যতামূলক। এর পর থেকেই বিশ্বব্যাপী কার্বন বাজারের শুরু। পরবর্তী কালে, ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তির ৬ অনুচ্ছেদে কার্যকরী কার্বন বাজার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে পারস্পরিক সহযোগিতার কথা বলা হয়। বাকু-তে সিওপি২৯-এ বিশ্বব্যাপী কার্বন বাজার নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত চুক্তি গৃহীত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, গরিব দেশগুলি বৃক্ষরোপণ ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো নানা প্রকল্প রূপায়ণ করে বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড বা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাবে এবং ‘কার্বন ক্রেডিট’ সঞ্চয় করবে। বিভিন্ন ধনী দেশ ও প্রতিষ্ঠান কার্বন বাজার থেকে অর্থের বিনিময়ে ওই সঞ্চিত ‘কার্বন ক্রেডিট’ কেনার সুযোগ পাবে। সব কিছু ঠিক থাকলে, আগামী বছরেই রাষ্ট্রপুঞ্জের সহায়তায় এই বাণিজ্য শুরু হতে পারে। তবে ইতিমধ্যেই বিক্ষিপ্ত ভাবে কার্বন ক্রেডিটের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য শুরু হয়েছে।
কার্বন ক্রেডিট কী?
কার্বন ক্রেডিট হল বাণিজ্যযোগ্য কার্বন অফসেট। কৃষি বা শিল্পে ব্যবহারিক পরিবর্তন ঘটিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোকে কার্বন অফসেট বলে, যা ‘ক্যাপ অ্যান্ড ট্রেড’ সিস্টেমের তত্ত্বাবধানে বিনিময় করা হয়। ১ টন কার্বন ডাই-অক্সাইডকে এক ‘কার্বন ক্রেডিট’ ধরেই কার্বনের বিনিময় চলে। এই ‘ক্যাপ অ্যান্ড ট্রেড’ সিস্টেমে, দেশ বা কোম্পানিগুলি কতটা কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছাড়তে পারবে তার নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করা হয়। কার্বন নিঃসরণের নির্ধারিত সীমার বেশি কার্বন কেউ বাতাসে ছাড়লে তাকে অর্থের বিনিময়ে সম পরিমাণ কার্বন কারও কাছ থেকে কিনতে হয়। এটা এক প্রকার ক্ষতিপূরণ বলা যেতে পারে। ‘ক্যাপ এবং ট্রেড’ সিস্টেমের আওতাভুক্ত দেশ বা কোম্পানিগুলি নিজেদের মধ্যে স্বাধীন ভাবে এই বিনিময় করতে পারে। এই ব্যবস্থায় বাতাসে কার্বনের মাত্রা কমানো সম্ভব হয়। এখন জানা যাক, একজন চাষি কী ভাবে কার্বন ক্রেডিটের সুবিধা পেতে পারেন। এ প্রশ্নের উত্তর পেতে আগে জানতে হবে কার্বন চাষ কাকে বলে।
কার্বন চাষ কী?
জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে, গাছ এবং অন্যান্য জৈব পদার্থের সাহায্যে বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইডকে মাটিতে সংরক্ষণ করতে যে কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়, সেটাই কার্বন চাষ। এই চাষে জমিতে লাঙল চালানো প্রায় বন্ধ, রাসায়নিক সারের ব্যবহার বর্জিত, সেচের উন্নতি ঘটিয়ে জল সংরক্ষণ এবং কৃষি বনায়ন প্রসারিত, বহুবর্ষজীবী ফসলের চাষের মাধ্যমে মাটির বিভিন্ন স্তরে কার্বন জমা করে মাটির কার্বন সঞ্চয় বর্ধিত।
এই পদ্ধতি গ্রহণ করে চাষি যদি ১ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমাতে পারেন, তা হলে তিনি এক ‘কার্বন ক্রেডিট’ সঞ্চয় করবেন, যা বিক্রি করে তিনি বাড়তি অর্থ উপার্জন করতে পারেন। তবে একটা কথা মনে রাখা জরুরি, বায়ুমণ্ডলে যতটা কার্বন মিশে রয়েছে, তার প্রায় তিন গুণ বেশি কার্বন মাটিতে সঞ্চিত আছে। যে হেতু বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ, তাই সচেতন থাকতে হবে মাটির সঞ্চিত কার্বন কোনও ভাবেই যেন বাতাসে না চলে আসে।
আরও পড়ুন:– ব্রিটেনই ভেঙে দিয়েছিল ভারতের উৎপাদন শিল্পের কোমর, কত টাকা লুট করেছিল তারা?
কার্বন ক্রেডিট কেনাবেচা
চাষি কী ভাবে এবং কাকে কার্বন ক্রেডিট বিক্রি করবেন? সাধারণত কোনও শিল্প বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এই কার্বন কেনে, যে তার নির্ধারিত সীমার বেশি কার্বন বাতাসে নিঃসরণ করেছে। ছোট এবং বড় অনেক কোম্পানিই এখন কার্বন অফসেটের জন্য কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি করছে। এই দুই স্তরের মাঝে থাকে কার্বন ক্রেডিট অ্যাগ্রিগেটর, যাদের কাজ কৃষকদের কাছ থেকে কার্বন ক্রেডিট কিনে সেগুলিকে এক জায়গায় করে চূড়ান্ত ক্রেতার কাছে সেই ক্রেডিট বিক্রি করা। তবে এই বিক্রির আগে যাচাইকারী সংস্থা দিয়ে নিশ্চিত করাতে হয়, প্রকৃতই কার্বন সংরক্ষণ হয়েছে কি না। উপগ্রহ-চিত্র ব্যবহার করে দেখা হয়, বাতাসে প্রত্যাশিত হারে কার্বন কমেছে কি না। মাটির নমুনা পরীক্ষা করে দেখতে হয়, মাটিতে সঞ্চিত কার্বনের পরিমাণ একই আছে না বেড়েছে।
ভারতীয় কৃষিতে কার্বন ক্রেডিট
দ্য ন্যাশনাল ইনোভেশন্স ইন ক্লাইমেট রেজ়িলিয়েন্ট এগ্রিকালচার (এনআইসিআরএ), পাইলট প্রকল্প হিসেবে দেশের ১০০টি পরিবেশগত ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জেলাকে কার্বন-নিউট্রাল গ্রামে রূপান্তরিত করতে উদ্যোগী হয়েছে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ কার্বন চাষে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করেছে। উদ্দেশ্য, ভবিষ্যতে এই চাষে নেতৃত্বদানকারী বিশেষজ্ঞ দল তৈরি করা।
বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা কৃষকদের কার্বন ক্রেডিট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোম্পানিগুলি গত দেড় বছরে দেশের প্রধান ধান-উৎপাদনকারী রাজ্যগুলিতে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ১০ হাজার চাষির ২৫ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে ক্লাইমেট-স্মার্ট এগ্রিকালচারের প্রয়োগ ঘটিয়েছে। তবে এই মুহূর্তে ভারতীয় কৃষিতে নির্গমন হ্রাসের কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নেই। গ্রো ইন্ডিগো বিভিন্ন কার্বন প্রোগ্রামের মাধ্যমে হরিয়ানা, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলঙ্গানায় ৮০ হাজার কৃষকের ৪০ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমির ফসল-বৈচিত্রকে (ক্রপ ডাইভার্সিফিকেশন) বিবেচনায় নিয়ে এসেছে। তাদের অভিজ্ঞতা, কার্বন প্রকল্পগুলি ক্ষুদ্র চাষিদের কাছে কৃষি-পদ্ধতি পরিবর্তনের একাধিক সুযোগ এনে দিয়েছে। চাষিরা ধান, গম, তুলো, ভুট্টা ও আখ চাষের জমিতে লাঙল দিচ্ছেন না। কৃষি বনায়নের প্রসার ঘটিয়ে মাটির জৈব বায়োমাস সংরক্ষিত হচ্ছে। সরাসরি বীজধান জমিতে ছড়িয়ে চাষ (ডিএসআর) করায় জল ব্যবহারের দক্ষতা অনেক বেড়েছে। এ বছর ধান এবং গম চাষের আগে গ্রো ইন্ডিগো কার্বন প্রকল্প চাষিদের নাম নথিভুক্ত করেছে। লক্ষ্য, চাষিদের কার্বন ক্রেডিটের সুবিধা দেওয়া।
ভারতীয় কৃষিতে ৫০টিরও বেশি সক্রিয় কার্বন প্রকল্প এবং একটি ভিসিএম আছে। তবে অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, হরিয়ানা এবং মধ্যপ্রদেশের সাতটি কার্বন চাষ প্রকল্পে গ্রামের ৮৪১ জন অংশগ্রহণকারী কৃষকের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ মহিলা। প্রায় ৯৯ শতাংশ কৃষক কোনও আর্থিক সুবিধা পাননি। কার্বন প্রকল্পের মূল সমস্যা, ৮০ শতাংশেরও বেশি জোত ছোট এবং প্রান্তিক। সেই জমিকে একত্রিত করে কার্বন চাষের প্রয়োগ খুবই চ্যালেঞ্জিং। আর একটি বড় চ্যালেঞ্জ হল, ভিসিএম-এ অংশগ্রহণ করার জন্য সচেতনতা এবং জ্ঞান চাষিদের নেই। তার উপর, কার্বন ক্রেডিটের জন্য নাম নথিভুক্ত করতেই ১.৫ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। টাকা পেতে আরও ৮-১২ মাস। গবেষণায় দেখা গেছে, কার্বন লেনদেনের খরচ (যেমন পরিমাপ, পর্যবেক্ষণ, তৃতীয় পক্ষের যাচাই এবং শংসাপত্র ইত্যাদি) খুব বেশি। প্রস্তাবিত কার্বন প্রকল্পগুলি রূপায়ণের আগে এবং পরে মাটিতে কার্বনের যথাযথ পরিমাপ আর একটি বড় সমস্যা। সুনির্দিষ্ট পরিমাপের জন্য প্রযুক্তি, ডেটা এবং প্রশিক্ষিত কর্মী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় কৃষিতে কার্বন ক্রেডিট বাজার একেবারে প্রারম্ভিক পর্যায়ে রয়েছে। এটির কঠোর নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। নইলে সামঞ্জস্যহীন তথ্য, অস্বচ্ছতা এবং পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণের অভাবে কার্বন ক্রেডিটগুলির যথাযথ মূল্য নির্ধারণ হবে না। ভিসিএম-এর দ্রুত প্রসারের সঙ্গে ভিসিএম সম্পর্কে স্বচ্ছতা, নিয়ন্ত্রণ এবং সচেতনতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এই ব্যাপারে সরকারের নীতিগত পদক্ষেপেরও প্রয়োজন আছে। কারণ, কার্বন ক্রেডিট ও তার কেনাবেচা সম্পর্কে কৃষকের সচেতনতার অভাব থেকে গেল তা তাঁকে বাড়তি আয় দেওয়ার পরিবর্তে রীতিমতো শোষণই করে চলবে।
লেখক কৃষি-অর্থনীতি গবেষক