Bangla News Dunia, বাপ্পাদিত্য:- ফলের মাছি, যেগুলিকে কৃষিক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপজ্জনক হিসেবে ধরা হয় ৷ এই মাছিগুলির জন্য বিভিন্ন ফল-সবজির গুণগতমান খারাপ হয়ে যায় ৷ সেই খারাপ ফল বা সবজি খেয়ে মানবশরীরে বাসা বাঁধতে পারে বিভিন্ন রোগ ৷ আবার কৃষিকাজের উপরও প্রভাব পড়ে ৷ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় চাষিদের ৷
এই ক্ষতি বন্ধ করতে গেলে সবচেয়ে প্রথমে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট মাছগুলিকে সনাক্ত করা ৷ তার পর কীভাবে চাষের সময়ই এই মাছিগুলির হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করা যাবে, তা নিশ্চিত করা ৷
এক্ষেত্রে জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বা জেডএসআই-এর একটি গবেষণা সমস্যা সমাধানে আশার কিরণ নিয়ে এসেছে ৷ জেডএসআই-এর গবেষকরা অন্তত ফলের মাছি থেকে হওয়া সমস্যার সমাধানের প্রথম ধাপ পার করতে পেরেছেন ৷ অর্থাৎ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে যে ঠিক কোন কোন প্রজাতির মাছির জন্য এই সমস্যা তৈরি হচ্ছে (আটটি প্রজাতি সনাক্তকরণ করা গিয়েছে) ৷ এবার প্রয়োজন ঠিক কোন উপায়ে এই মাছির থেকে সবজি-ফলকে রক্ষা করা যাবে, তার উপায় বের করা ৷
কীভাবে গবেষণা হল ?
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ও জেডএসআই গবেষকদের যৌথ উদ্যোগে রাজ্যের গাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গের 30টি জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা চালানো হয় । দিনের বেলা সুইপ-নেট পদ্ধতি ব্যবহার করে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণবঙ্গের কিউকারবিটাসিয়াস উদ্ভিদ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয় । মাছির রূপগত সনাক্তকরণ ও নামকরণ ফলের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল । সমস্ত নমুনা স্থানের ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক রেকর্ড করা হয়েছিল । সংগৃহীত নমুনাগুলি 70 শতাংশ অ্যালকোহলে সংরক্ষিত ছিল ।
ফলের মাছি (সৌজন্যে – জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া)
প্রজাতি সনাক্তকরণের জন্য বেশ কয়েকটি শ্রেণীবিন্যাস ব্যবহার করা হয়েছিল । ডিজিটাল ইমেজ প্রসেসিংয়ের জন্য একটি লেইসা ডিএফসি 500 ক্যামেরা ও লেইসা অ্যাপ্লিকেশন স্যুট এলএএস ভি3.6 সফ্টওয়্যার ব্যবহার করা হয় ৷ এর সঙ্গে লেইসা স্টিরিও-আইএসও মাইক্রোস্কোপ এম205এ ব্যবহার করে মাছির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও শরীরের বিভিন্ন অংশের দশটি ছবি তোলা হয় ।
ফোটোমাইক্রোগ্রাফ থেকে আটটি প্রজাতির প্রতিটি থেকে 5টি প্রাপ্তবয়স্ক মাছির গড় দৈর্ঘ্য (মিলিমিটারে) এবং উইং স্প্যান (মিলিমিটারে) রেকর্ড করা হয়েছিল । তাদের নমুনাগুলি কলকাতার জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ন্যাশনাল জুলজিক্যাল কালেকশনে (এনজেডসি) জমা আছে ।
কোন কোন প্রজাতির মাছি সনাক্ত করা হল ?
- জিউগোডাকাস কাউডাটা (ফ্যাব্রিসিয়াস, 1805)
- ব্যক্ট্রিসেরা(বি) কারেক্টা (বেজ্জি1916)
- জিউগোডাকাস কিউকুরবাইটে(কোকিলেট, 1899)
- ব্যাকট্রোসেরা (বি) ডরসালিস (হেন্ডেল, 1912)
- জিউগোডাকাস টাউ (ওয়াকার, 1849)
- ব্যাকট্রোসেরা (বি) জোনাটা (সন্ডার্স, 1842)
- জিউগোডাকাস (হেমিগিমনোডাকাস) ডাইভারসা (কোকুইলেট, 1904)
- ডাকউস (কালান্ত্রা) লঙ্গিকরনিস ওয়েডেম্যান (1830)
কোন পদ্ধতিতে সনাক্ত করা হয়েছে ?
জেডএসআই-এর এই গবেষণায় চরিত্র-ভিত্তিক ডিএনএ বারকোডিং পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছিল । যা কিউকারবিট ফসলে আক্রান্ত ফলের মাছিকে দ্রুত ও সঠিক সনাক্তকরণের জন্য অন্যতম উপযুক্ত হাতিয়ার বলে মনে করছেন গবেষকরা । যা বৃহত্তর পরিসরে এই পদ্ধতির প্রয়োগ কৃষি উৎপাদনশীলতা রক্ষা, দীর্ঘমেয়াদি ফসল উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও ফসলের সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক ক্ষতি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে ।
ক্ষতিকারক আট প্রজাতির ফলের মাছি (সৌজন্যে – জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া)
গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের কৃষি প্রধান জেলাগুলিতে ভ্রমণ করে গবেষকদল কুমড়ো, শসা এবং লাউয়ের মতো ফসলের জন্য ক্ষতিকারক বিভিন্ন প্রজাতির ফলের মাছির নমুনা সংগ্রহ করে মাইটোকন্ড্রিয়াল সিওআই (সাইটোক্রোম অক্সিডেজ সাবইউনিট 1) জিন থেকে 30টি নিউক্লিওটাইড স্থান চিহ্নিত করেছেন ।
কোন কোন ফল বা সবজিতে এই মাছি পাওয়া যায় ?
কুমড়ো, বিন্দুযুক্ত করলা, শসা কুমড়ো, সাদা করলা, স্পঞ্জ করলা, বড় লাউ, সাপের মতো লম্বা লাউ ও তরমুজ ইত্যাদি ।
এই মাছিগুলিকে সনাক্ত করার কারণ ?
এই মাছির উপদ্রপ কমাতে কৃষকরা কীটনাশক ব্যবহার করেন । কৃষিকাজে ক্ষতি ঠেকাতেই কীটনাশক ব্যবহার করেন কৃষকরা । না হলে শশা, কুমড়ো, লাউয়ে পচন ধরতে দেখা যায় । কোনও কোনও ফল আবার বৃদ্ধি পাওয়ার পর কোনও একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পচন ধরে । কীটনাশক প্রয়োগ করে মাছির উপদ্রপ কিছুটা কমানো গেলেও সামগ্রিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হন কৃষকরা । তবে মাছি কমানো গেলেও তাঁদের লার্ভা রয়েছে । বহু ক্ষেত্রে সেই লার্ভার কারণেই ফলের ক্ষতি হয় । গবেষকদের বক্তব্য, সঠিক কীটনাশক প্রয়োগ করার পরও ফসলে আক্রমণকারী কীটপতঙ্গ রয়ে যায় । সেই প্রজাতির কীটপতঙ্গ সঠিকভাবে সনাক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
গবেষণার স্বীকৃতি
আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন জার্নাল বিএমসি জিনোমিক্সে প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রটি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগৃহীত টেফ্রিটিডি পরিবারের ফলের মাছির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে । গবেষক দলে ছিলেন অঙ্কুশ মিত্র, পূবালী মিত্র, প্রদোষ মহাদানি ও সুব্রত ত্রিবেদী বিশ্বাস । তাঁরা জানান, তাদের এই আবিষ্কার কৃষি উৎপাদনশীলতা রক্ষায় সহায়ক হবে । তারা এই পদ্ধতিটি বিভিন্ন অঞ্চলে প্রয়োগ করা এবং কীটপতঙ্গের বিস্তৃত পরিসরে প্রয়োগ করার পরিকল্পনা করছেন । যা কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে বহুমুখী ও কার্যকরী পদ্ধতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা ?
জেডএসআই-এর অধিকর্তা ড. ধৃতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ফলের মাছি কৃষিকাজের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক পোকামাকড়গুলির মধ্যে অন্যতম । পশ্চিমবঙ্গের 70 শতাংশ গ্রামীণ পরিবার কৃষির উপর নির্ভরশীল । এই গবেষণায় পাওয়া ফলাফল শুধুমাত্র ফসল রক্ষা করতেই সহায়ক হবে না, বরং রাসায়নিক কীটনাশকের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতাও কমাবে । এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা পরিবেশের ক্ষতিও কমাতে পারব এবং তার সঙ্গে কৃষিকাজে যুক্ত মানুষেরা সুনির্দিষ্ট সরঞ্জাম দিয়ে ক্ষমতায়নও করতে পারব ।”
জেডএসআই-এর সিনিয়র জুলজিক্যাল আসিস্ট্যান্ট অঙ্কুশ মিত্র বলেন, “ফলের মাছি সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয় বিপজ্জনক বিষয় । এই মাছির সংক্রমণের ফলে ফল ও সবজি পচে যায় । প্রায় প্রতি বছর বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতিও হয় । এই কীটপতঙ্গের কারণে অনেক দেশ বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীনও হয় । যুগান্তকারী এই গবেষণা ডিপটেরা বর্গের টেফ্রিটিডি পরিবারের ফলের মাছির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি হাতিয়ার হয়ে উঠবে ।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘এই নতুন পদ্ধতি দ্রুত, নির্ভুল এবং নির্ভরযোগ্য প্রজাতি সনাক্তকরণে সক্ষম হবে । এই পদ্ধতি ব্যবহার করে কীটপতঙ্গের প্রাদুর্ভাবের সময় আগেভাগেই হস্তক্ষেপ করে ফসলের ক্ষতি কমানো সম্ভব হবে । যা কীটপতঙ্গ প্রতিরোধী ব্যবস্থাপনায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করবে । বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে এই গবেষণা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ।”
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মধুসূদন দাস বলেন, “ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যকর খাবারের চাহিদাও ঊর্ধ্বমুখী । তাই যথোপযুক্ত কৃষি অনুশীলন সুনিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । নির্দিষ্ট ফলের মাছি প্রজাতিকে নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের কৌশল কার্যকর হলে কৃষিজমিতে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাসপ্রাপ্ত হবে । যা স্বাস্থ্যকর বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সাহায্য করবে ।”
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কাজলকৃষ্ণ বণিক বলেন, “ঘরোয়া মাছি হোক বা ফলের মাছি, মানব জীবনে নানারকম রোগ ও সমস্যার কারণ হতে পারে তারা । তাদের বিভিন্ন ধরন ও প্রজাতি আছে । খোলাখাবার এদের লার্ভার কারণে ফুড পয়জনিং থেকে শুরু করে একাধিক রোগ হতে পারে । তাই রান্না করা খাবার যেমন ঢেকে রাখা প্রয়োজন ঠিক তেমনি কাঁচা সবজি বা ফল খাওয়ার আগে, তা ভালোভাবে ধুয়ে খাওয়া উচিত । এরা শুধুমাত্র ফুটবল জেনিংয়ের কারণ নয় নানারকম নোংরা পরিবেশে বেড়ে ওঠা এবং নানারকম রোগের বাহক হিসেবে এরা কাজ করে ।”
আরও পড়ুন:- কলকাতা টু বারাণসী 6 ঘণ্টায় ! তৈরি হচ্ছে নয়া এক্সপ্রেসওয়ে