পাশ-ফেল ফিরলেই শিক্ষার দৈন্যদশা ঘুচবে? কি বলছেন শিক্ষাবিদ? জানুন

By Bangla News Dunia Desk Bappaditya

Published on:

schoolbag

Bangla News Dunia, বাপ্পাদিত্য:- ‘একটা গোটা জাতিকে ধ্বংস করতে পরমাণু বোমা কিংবা মিসাইলের মতো ক্ষেপণাস্ত্রের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন স্রেফ দেশের শিক্ষার মানকে লঘু করে পরীক্ষায় অসাধু উপায়ের পথ বাতলে দেওয়া’। নেলসন ম্যান্ডেলার এই উক্তি আজও লেখা রয়েছে প্রিটোরিয়ায় ‘ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ আফ্রিকা’র প্রবেশদ্বারে। উক্তিটি ভারতেও এখন সমান প্রাসঙ্গিক। কারণ, এই কলিযুগে শিক্ষা আদতে অধিকার নাকি সুযোগ অথবা পণ্য নাকি পরিষেবা, এমন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে গত কয়েক দশক ধরেই এ দেশের শিক্ষানীতিকে ঘিরে।

সাম্প্রতিক কালে নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতি, ২০২০ এ দেশের সমাজে কতটা প্রাসঙ্গিক, তা নিয়েও তর্কবিতর্ক চলেছে। দেশের সরকার এ বার ঘোষণা করেছে যে, রাজ্যের পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী নয়, সার্বিক ভাবেই দেশজুড়ে পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে পাশ-ফেল প্রথা বাধ্যতামূলক ভাবে বলবৎ করতে হবে।

ইতিপূর্বে নয়া শিক্ষানীতি ঘোষণার পর বিদ্যালয় স্তরে পাশ- ফেল সংক্রান্ত বিষয়টি শিক্ষাকে সংবিধানের যৌথ তালিকার বিষয় মেনে রাজ্যগুলির হাতে ছেড়ে রাখা হয়েছিল। ফলে দেশের অঙ্গরাজ্যের আঠারোটি সরকার পঞ্চম এবং অষ্টম স্তরে পাশ–ফেলের পক্ষে সওয়াল করলেও বাকি আঠারোটা রাজ্যে সে পথে হাঁটেনি। কিন্তু এ দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় শিক্ষানীতি রূপায়ণের মাঝপর্বে কেন্দ্রীয় সরকারের এমন চটজলদি সিদ্ধান্ত কি শিক্ষার সার্বিক গুণমান নিশ্চিত করার প্রয়াস নাকি প্রশাসনিক কৌশল অবলম্বন করে স্কুল-শিক্ষার দৈন্যদশা ঢাকার প্রচেষ্টা, সেটা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।

শুধু স্কুলের লেখাপড়া নয়, যে কোনও ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীর উপযুক্ত মূল্যায়ন আবশ্যিক। কারণ শিক্ষার সার্বিক উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর সক্ষমতা, দক্ষতা এবং বোধের বিকাশ। ফলে পড়ুয়াদের বোধবুদ্ধির বিকাশের ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রয়োজন সামাজিক স্বার্থেই। সন্দেহ নেই, তেমন বহুমাত্রিক মূল্যায়নে পাশ–ফেলের মতো সনাতনী পদ্ধতির সম্যক গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু ধারাবাহিক মূল্যায়নের পরিবর্তে সেই মূল্যায়ন যদি খণ্ডিত হয় কিংবা কয়েক বছরের ব্যবধানে পাশ বা ফেলের প্রথা যদি পড়ুয়ার মানের মাপকাঠি হয়ে ওঠে, তখন তার যথার্থতা নিয়ে আনুষঙ্গিক প্রশ্ন ওঠে বইকি!

পড়ুয়াদের সাফল্য নির্ভর করে বহু বিষয়ের ওপরে। প্রতি দিন স্কুলের চৌকাঠ পেরোনোর মতো পারিবারিক আর্থিক সামর্থ্য, কিংবা স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা এবং তার গুণমান, আর্থ–সামাজিক প্রেক্ষিতে স্কুল-পাঠ্যের কার্যকারিতা, স্কুলে শিক্ষণ পদ্ধতি, এমন বহু বিষয়ের ওপরেই পড়ুয়াদের দক্ষতা এবং সক্ষমতা গড়ে ওঠে। এমন বিষয়গুলি ব্যাতিরেকে পড়ুয়াদের মূল্যায়নে পরীক্ষায় পাশ এবং ফেলের প্রথাকে ব্রহ্মাস্ত্র করা সমীচীন কি না, সেটা ভাবনার বিষয়।

দেশের নতুন শিক্ষানীতি ঘোষণার সঙ্গে যে সরকারি অঙ্গীকার ছিল, সেগুলি কতটা রূপায়িত হয়েছে, তা খতিয়ে না দেখলে পঞ্চম কিংবা অষ্টম শ্রেণিতে পাশ–ফেল নিয়ে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সম্প্রতি সংসদে পেশ করা এক রিপোর্টে প্রকাশিত যে, দেশের সরকারি বিদ্যালয়ের ৬২ লক্ষ শিক্ষক পদের মধ্যে প্রায় ১০ লক্ষ শূন্য পদ রয়েছে। দেশের মাত্র ৪০ শতাংশ স্কুলে বই সমেত লাইব্রেরি রয়েছে আর কম্পিউটারের ন্যূনতম সুযোগ রয়েছে স্রেফ ৭ শতাংশ স্কুলে।

গত কয়েক বছর ধরে সরকারি এবং সরকার পোষিত স্কুলগুলির সংখ্যা কমে চলেছে। নয়া শিক্ষানীতি অনুসরণ করে বিভিন্ন গ্রামীণ এবং দূরবর্তী এলাকার স্কুল সংযুক্তিকরণের নামে অজস্র সরকারি স্কুল তুলে দেওয়া হচ্ছে। এমন সংযুক্তিকরণের ফলে সমাজের দুর্বল অংশের পড়ুয়াদের সর্বজনীন শিক্ষার সুযোগ কমে চলেছে।

মোদী সরকারের আমলে ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২ সাল পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনার স্কুলের সংখ্যা কমেছে ৮৫ হাজার ৬৫৪টি আর বিপরীতে দেশজুড়ে বেসরকারি স্কুল ওই একই সময়ে বেড়েছে ৪৭ হাজার ৬৮০টি। নতুন শিক্ষানীতি প্রয়োগের পূর্বে স্কুলগুলির যে অধোগতির চিত্র ধরা পড়েছিল, সেই চিত্র আরও ব্যাপক আকার ধারণ করছে শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দের ছাঁটাইয়ের ধাক্কায়।

আরও পড়ুন:– ভারতের কব্জায় থাকা নদীর অংশ দখলমুক্ত করলো বাংলাদেশ, জানুন বিস্তারিত

দেশের নতুন শিক্ষানীতি রূপায়ণে সরকারি বরাদ্দের অঙ্গীকার ছিল দেশের জিডিপি-র শতাংশ। কিন্তু পূর্বতন ইউপিএ সরকারের আমলেও ২০০৪-২০১৪ পর্যন্ত শিক্ষায় গড়ে বিনিয়োগ ছিল জিডিপি-র মাত্র ০.৬১ শতাংশ আর সেই বরাদ্দ ২০২৪-২৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ০.৩৮ শতাংশে। দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার পরেই দেশের কন্যাসন্তানদের বিকাশের উদ্দেশ্যে স্লোগান দিয়েছিলেন ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’।

কিন্তু তৃতীয়বার দিল্লির সিংহাসনে বসে তাঁর সরকারের ‘পিএম গার্লস হস্টেল’ প্রকল্পে ৮০ শতাংশ বরাদ্দ ছাঁটাই হয়ে গেছে। কাজেই স্পষ্ট সরকারের ‘মন কি বাত’। পাশাপাশি বিদ্যালয় স্তরে তফসিলি জাতি, উপজাতি, ওবিসি এবং সংখ্যালঘু পড়ুয়াদের বৃত্তির ক্ষেত্রে বিপুল ছাঁটাই করা হয়েছে। ফলে প্রান্তিক পরিবারের পড়ুয়াদের স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। কমেছে এই অংশের স্কুল-শিক্ষায় ‘গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিও’।

দেশের স্কুল-শিক্ষা এবং সাক্ষরতা খাতে ২০১৩-১৪ সালের খরচ ছিল মোট বাজেটের ৩.১৬ শতাংশ কিন্তু এখন সেটাই ২০২৪-২৫ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১.৫৩ শতাংশ। এই তথ্য থেকে স্পষ্ট যে স্কুল-শিক্ষার বরাদ্দ আগের ইউপিএ সরকারের তুলনায় কার্যত অর্ধেকের বেশি কমে গেছে মোদী সাহেবের রাজত্বে। সমাজের প্রান্তিক পড়ুয়াদের স্কুলে প্রাপ্য ‘মিড ডে মিল’-এর বরাদ্দ বাড়ছে না এই মূল্যবৃদ্ধির আবহে। সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে সরে যাচ্ছে স্কুল-শিক্ষার মতো জরুরি বিষয়।

এক দিকে যখন গোটা দেশ মূল্যবৃদ্ধির আগুনে জ্বলছে, তখন শিক্ষায় সরকারের বাজেট বরাদ্দের এমন ঘাটতি স্কুলের পরিকাঠামোর উন্নয়নকে ব্যাহত করতে বাধ্য। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের মাস-মাইনে কিংবা পেনশনের বাইরে চক-ডাস্টার, ক্লাসঘর, লাইব্রেরি, ইন্টারনেট, পানীয় জল, ছাত্রীদের শৌচাগারের সুযোগ রুদ্ধ কারণ উন্নয়ন খাতে বাজেট ছাঁটাই হয়েছে ৩৫ শতাংশ।

পরিকাঠামো এবং সরকারি বরাদ্দের এমন হাঁড়ির হাল নিয়ে পড়ুয়াদের পাশ-ফেলের বাইনারি দিয়ে বিচার করা যায়? দেশের কিংবা রাজ্যের সরকার যদি তাদের আর্থ–সামাজিক অঙ্গীকার রক্ষায় ফেল করে, তবে সেই সরকারি ব্যবস্থায় দলে দলে পড়ুয়ারা পাশ করবে কোন জাদুমন্ত্রে? ফেল-করা সরকারের দায় ফেল-করা পড়ুয়ার দায়ের চেয়ে ঢের বেশি। এটা বিবেচনায় রেখেই মূল্যায়নের মাপকাঠি স্থির করা প্রয়োজন।

সরকারের প্রস্তাবিত নতুন পরীক্ষা সংস্কারে পাশ-ফেলের প্রথা প্রণয়নে প্রশাসনিক কৌশল স্পষ্ট। এই সংস্কারের অংশ হিসাবে বিদ্যালয় স্তরে প্রাক-মাধ্যমিক স্তরের ছাড়পত্র হিসাবে পঞ্চম শ্রেণিতে এবং মাধ্যমিক স্তরে ছাড়পত্রের লক্ষ্যে অষ্টম শ্রেণিতে পাশ-ফেল প্রথা বলবৎ করার কথা প্রস্তাবিত হয়েছে। এখানেই প্রশ্ন, পড়ুয়ার মূল্যায়নে পাশ-ফেলের ছাঁকনি যদি অপরিহার্য হয়, তা হলে সেটা ফি বছর করা হবে না কেন? প্রথম থেকে পঞ্চম পর্যন্ত পড়ুয়ার পড়াশোনায় যদি ধারাবাহিক ঘাটতি থেকে থাকে, তা হলে কোন জাদুতে পাঁচ বছরের সেই ঘাটতি মিটবে পঞ্চমের বার্ষিক পরীক্ষায়? পঠনপাঠনের পরিকাঠামো কিংবা শিক্ষকের মান যদি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে না পারে, সে ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের প্রতিটি শ্রেণিতেই অদক্ষ পড়ুয়াদের সংখ্যাই ভারি হবে। ফলে হঠাৎ করে পঞ্চম কিংবা অষ্টম শ্রেণিতে পৌঁছে ব্রেক কষার অর্থ পরিষ্কার হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ফেল-করা পড়ুয়াদের পাশ করাতে দু’মাসের বিশেষ ‘কোচিং’ কি কখনও ধারাবাহিক অক্ষমতা দূর করার উপায় হতে পারে?

সাম্প্রতিক কালে ‘অ্যানুয়াল স্টেটাস অফ এডুকেশন রিপোর্ট, ২০২৩’-এ প্রকাশিত যে গ্রামীণ ভারতে ১৪-১৮ বছর বয়সি পড়ুয়াদের মাত্র ৪৩ শতাংশ তৃতীয়–চতুর্থ শ্রেণির তুল্য অঙ্ক কষতে পারে আর ৫৩.৩ শতাংশ পড়ুয়া ওই মানের ইংরেজি বাক্য পড়তে পারে। আবার যারা ইংরেজি বাক্য পড়তে পারে তাদের ২৬.৫ শতাংশ তার অর্থ বলতে অপারগ। ফলে স্কুল-পড়ুয়াদের সক্ষমতার এই মানকে উন্নত না করে মুখস্থ-নির্ভর পরীক্ষা-ব্যবস্থায় পাশ-ফেলের বাইনারি দিয়ে তাদের সাফল্য– ব্যর্থতা বিচার করা অনুচিত।

সরকারি ঘোষণায় স্পষ্ট যে, প্রতীকী উন্নয়নের মাপকাঠি হিসাবে সরকার পাশ-ফেলের অস্ত্র প্রয়োগ করতে চাইছে। এই কৌশলের মধ্যে নিহিত ফাঁকির কারণেই পঞ্চম কিংবা অষ্টম শ্রেণিতে পাশ-ফেলের জুজু দেখিয়ে আখেরে লাভ হবে না। যে কোনও ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভর করে তার ইনপুট আর আউটপুটের অনুপাতের উপর। শিক্ষায় ইনপুট হল সরকারি উদ্যোগ আর আউটপুট হল পড়ুয়াদের মান।

ফলে উন্নত মানের পড়ুয়া তৈরি করতে প্রয়োজন উন্নত মানের সরকারি ব্যবস্থাপনা। কিন্তু নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের নামে সরকার সর্বজনীন শিক্ষার মূল লক্ষ্য থেকে সরে যাচ্ছে শিক্ষার বরাদ্দ ছাঁটাই করে। শিক্ষাকে বাণিজ্যিক সুযোগে পরিণত করছে এই নীতি, সরকারি শিক্ষার বিকল্প হিসাবে বেসরকারি শিক্ষার বিকাশ ঘটিয়ে। আর এখানেই বিপদ। দেশের কোটি কোটি প্রান্তিক পরিবারের পড়ুয়াদের ভরসার এপিসেন্টার সরকারি স্কুলগুলির অন্তর্জলি যাত্রা শুরু হয়েছে সরকারি নীতির হাত ধরেই। সরকারের পাশ-ফেল সংক্রান্ত নীতি পরিবর্তনকে সরকার শিক্ষার অধিকার আইনের (২০০৯) সংশোধনী হিসাবেই বিবেচনা করেছে। কিন্তু অপ্রকাশ্যে সরকারের প্রস্তাবিত নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি (২০২০) আসলে এ দেশের শিক্ষার অধিকারকেই নস্যাৎ করতে চাইছে। দুশ্চিন্তা এখানেই।

লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণবিদ্যার শিক্ষক

 

আরও পড়ুন:– কলেজে পড়ুয়াদের ৩০ হাজার টাকা স্কলারশিপ দিচ্ছে HDFC ব্যাংক, কিভাবে আবেদন করবেন? দেখে নিন

 

Bangla News Dunia Desk Bappaditya

মন্তব্য করুন