Bangla News Dunia, সোমা কর্মকার :- ফুরিয়ে আসছে ইংরেজি বছর, আগামী বছরের জন্য ঘন ও প্রবল হয়ে উঠছে তর্ক। সে তর্কে প্রতিহিংসার যুক্তি প্রবল, ইতিহাসের খণ্ড-দর্শন মুখ্য, লেকচারের ভঙ্গিই সর্বস্ব, রাষ্ট্রই পরমব্রত— তর্কপরায়ণরা একে অপরকে নিজের কথা শোনাতে চান, অনুভব করেন না, অপরের কথা শুনতে চান না মোটে। তাতে কলহ প্রবল হয়, সমাধান হয় না। কলহের মূলে ধর্ম, ধর্মে-ধর্মে মারামারি।
কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের ভাবখানা এই, প্রতিবেশী রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু হিন্দুরা মার খাচ্ছে তাই সাধু সাবধান। সেই মারের কথা মনে রেখে এ দেশের হিন্দুদের একজোট হওয়া চাই, হিন্দু শরণার্থীদের বিশেষ ভাবে সাহায্য করা প্রয়োজন এবং এ দেশের মুসলমানদের নানা ভাবে চাপে রাখা আবশ্যক। তা করতে গিয়ে এ দেশের হিন্দু-মুসলমানের অশাস্ত্রীয় বহুধাবিস্তৃত ধর্মীয় বিন্যাসের মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও যে দেওয়া-নেওয়া ছিল তার অভিমুখ যাচ্ছে বন্ধ হয়ে, দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই পরস্পরের প্রতি সন্দেহ উঠছে জেগে। দুই পক্ষের বিভেদকামী ধর্মধ্বজীরা অবশ্য তা-ই চান।
এর সমাধান কোথায়? ধর্মবিবিক্ত কট্টর-যুক্তিবাদেই কি সমাধান মিলবে, না কি এ দেশে দুই ধর্মের ও দুই সমাজের মানুষের মধ্যে যুক্তি-অযুক্তি, পার্থক্য-সাদৃশ্য মিলে-মিশে যে পারস্পরিকতা গড়ে উঠেছিল তারই দ্বারস্থ হতে হবে? শাস্ত্রে আছে রুচি ঋজু-কুটিল বহুমাত্রিক। সকলে ধর্মবিবিক্ত কট্টর যুক্তিবাদী হয়ে উঠবেন না। আবার ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম মানেন ও সেই ধর্মের বিশেষ অভ্যাসে স্বস্তিবোধ করেন বলেই অপর ধর্মাবলম্বীদের প্রতি হিংসা-দ্বেষ পোষণ করবেন একথা ভাবার অর্থ হয় না। বরং বলতে দ্বিধা নেই কট্টর যুক্তিবাদীদের থেকে এ দেশে সহনশীল সুসামাজিক ধর্মবিশ্বাসীদের সংখ্যাই বেশি।
[ আরো পড়ুন :- পাক সেনা ফের জঙ্গি মজবুত করছে ,নজর রাখছে ভারত ]
এই সহনশীল সুসামাজিকতা এক দিনে গড়ে ওঠেনি। রাজনৈতিক-সামাজিক বিরোধ অনেক সময় উপরিতলে কাজ করেছে আর তারই অন্তরালে গড়ে উঠেছে সহনশীল ধর্মীয় পারস্পরিকতা। এই পারস্পরিকতা তলা থেকে উপরে গিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক হানাহানিকে রোধ করতেও সমর্থ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বিষয়টি খেয়াল করেছিলেন। বিশ্বভারতীর বিদ্যাভবনের অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন ১৯২৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধর মুখার্জি স্মারক ভাষণ দেন।
‘ভারতীয় মধ্যযুগে সাধনার ধারা’ নামে সেই ভাষণের ভূমিকা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ইউরোপের মধ্যযুগের চেয়ে ভারতের মধ্যযুগের চরিত্র যে আলাদা ক্ষিতিমোহন-রবীন্দ্রনাথ দু’জনেই তা জানেন। ইংরেজ শাসনাধীন ভারত তখন স্বাধীনতা আদায়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
হিন্দু-মুসলমান সঙ্কট মাথা তুলেছে। মুসলিম লিগ ও হিন্দু মহাসভা তাদের দাবি উচ্চৈঃস্বরে জানাতে শুরু করেছে। আগামী ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর রাষ্ট্র হিসেবে কেমন চেহারা নেবে তারও নানা আভাস-ইঙ্গিত চোখে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভূমিকায় খেয়াল করিয়ে দেন ‘‘এ কথা মানতে হবে যে রাষ্ট্রিক সাধনা ভারতের সাধনা নয়।’’ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল রাষ্ট্রনির্মিত ধর্ম-পরিচয় ও সমাজনির্মিত শাস্ত্রীয় ধর্মাচার এ দেশের মঙ্গল বিধান করবে না।
তাঁর অভিমত, ‘‘ভারতের একটি স্বকীয় সাধনা আছে; এই সাধনা অনেকটা পরিমাণে অশাস্ত্রীয়, এবং সমাজশাসনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। এর উৎস জনসাধারণের অন্তরতম হৃদয়ের মধ্যে, তা সহজে উৎসারিত হয়েছে, বিধিনিষেধের পাথরের বাধা ভেদ করে।’’
রবীন্দ্রনাথের ভাষা-ভঙ্গিকে সহজ করে নিলে মোদ্দা কথাটা এই রাষ্ট্র ও সমাজ এক রকম একমুখী রেজিমেন্টেশন, অনুশাসন তৈরি করতে চায়। সেই অনুশাসন এই দেশের জনসাধারণ মানেননি। মধ্যযুগের হিন্দু-মুসলমানের অশাস্ত্রীয় অনুভবের ধর্মে নানা মত-পথ মিলেমিশে গিয়েছে। ফলে রাষ্ট্রিক-সামাজিক অনুশাসনের তলায় হানাহানি মারামারির বাইরে গড়ে উঠেছে পারস্পরিকতার সহজ সম্পর্ক।
সেই সহজ সম্পর্কের ইতিহাসকার ক্ষিতিমোহন সেন। ক্ষিতিমোহন লেখেন ‘‘মুসলমান-আক্রমণে তীর্থমন্দির ও নানাবিধ ধর্মক্ষেত্র বার বার বিপন্ন হইল সত্য, কিন্তু ধর্মের প্রধান স্থান হৃদয়মন্দির ক্রমে জাগ্রত হইয়া উঠিতে লাগিল।’’ পরে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এটিকেই তুর্কিয়ানা থেকে সুফিয়ানার পথে যাত্রা বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
তিনি লিখেছিলেন দোরাপ গাজির বৃত্তান্ত। গাজি লড়াই করতে এসেছিলেন বটে কিন্তু শেষে সংস্কৃতে গঙ্গাস্তোত্র লিখলেন। এই জেগে ওঠা হৃদয়মন্দিরের স্পর্শেই সুনীতিকুমারের মতে গড়ে উঠল ইসলামের ভারতীয় রূপ, আর ইসলামের সঙ্গে বোঝাপড়ায় ক্ষিতিমোহনের মতে অশাস্ত্রীয় ভক্তিধর্মের জাগরণ হল। কথাগুলি বিশ শতকে অকারণে উচ্চারণ করা হয়নি। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্মীয় হানাহানির প্রতিরোধক হিসেবেই তা তুলে ধরা হয়েছিল।
[ আরো পড়ুন :- নতুন বছরের বাজেটে কি কি জিনিসের ওপর নজর থাকবে কেন্দ্রের ]
১৯৩০ সালে ক্ষিতিমোহনের বক্তৃতা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কয়েক বছর পরে ১৯৩৬ সালে রামকৃষ্ণদেবের জন্মের শতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শরণ করে একটি ছোটো কবিতা লেখেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘বহু সাধকের বহুসাধনার ধারা/ ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তারা।’’
আধুনিক নগর কলকাতার কাছে গ্রাম-দক্ষিণেশ্বরে যে সাধক-জীবন রামকৃষ্ণদেব কাটিয়েছিলেন তা নিয়ে এক সময় রবীন্দ্রনাথের মনে সংশয় ছিল। এই সংশয় ত্রিশের দশকে এসে বোধ হয় কেটে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন যে অশাস্ত্রীয় ধর্মসাধনার ধারা মধ্যযুগে গড়ে উঠেছিল রামকৃষ্ণদেব সেই সাধনধারারই উত্তরাধিকারী।
রামকৃষ্ণদেবের যখন ধর্মানুভবের কথা বলছেন তখন আধুনিক ইংরেজিশিক্ষার বশবর্তী হয়ে কলকাতার ভদ্রলোকেরা ধর্মকে নেশন-সমাজ ইত্যাদির আদর্শ গড়ে ওপরের দিক থেকে জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন। রামকৃষ্ণের সে সব বালাই নেই। ধর্ম তাঁর কাছে স্বদেশ-সমাজ-হিতবাদ ইত্যাদির অনুপান নয়। তা ঐকান্তিক অনুভব। সেই অনুভবে শাস্ত্র গৌণ। তাই শাস্ত্র মেনে দক্ষিণেশ্বরে পুজো করতেন না তিনি। যা মনে হত প্রাণভরে তাই দেবীকে নিবেদন করতেন।
রামকৃষ্ণদেবের কথামৃত যদি মন দিয়ে পড়া যায় তা হলে দেখা যাবে কোনও রাষ্ট্রিক হিন্দুধর্মের কল্পনা তিনি করেননি। তিনি বলেন, ‘‘সব ধর্ম এক বার করে নিতে হয়। …আমায় সব ধর্ম এক বার করে নিতে হয়েছিল— হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান আবার শাক্ত, বৈষ্ণব, বেদান্ত— এ সব পথ দিয়েও আসতে হয়েছে।’’ খেয়াল করলে দেখা যাবে ধর্মের রাষ্ট্রিক বা সামাজিক রূপের কথা তিনি ভাবেননি বলেই বলতে পারেন সব পথেই তাঁকে পাওয়া যায়। একই জল— হিন্দুরা বলে জল, মুসলমানেরা বলে পানি।
তিনি দেখছেন এক জায়গায়, ‘‘ইংরেজ, মুসলমান, আমি নিজে, মুদ্দোফরাস, কুকুর, আবার একজন দেড়েল মুসলমান হাতে এক সানকি, তাতে ভাত রয়েছে। সেই সানকির ভাত সব্বাইয়ের মুখে মুখে একটু একটু দিয়ে গেল, আমিও একটু আস্বাদ করলুম।’’ রামকৃষ্ণদেবের মুখের ভাষা কেঠো-শীলিত ধর্ম-সম্মিলনের ভাষা নয়। ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ হওয়ার দায় তাঁর নেই।
[ আরো পড়ুন :- কাশ্মীর নিয়ে ইসলামী দেশগুলির বৈঠকে রাজি হলো সৌদি ]
দেড়েল মুসলমান বলতে তাঁর আটকায় না, কিন্তু অনুভব করেন একই সানকির ভাত সকলের খাওয়া চাই। ভক্তদের বলেন ‘‘সব কাজ ফেলে সন্ধ্যার সময় তোমরা তাঁকে ডাকবে… — মোসলমানরা দেখো ঠিক সময়ে নমাজটি পড়বে।’’ মাঝে মাঝে ভদ্রলোক ভক্তেরা দেশ-বিদেশের খবর তাঁকে বলেন। কাবুলের খবর এল, ইয়াকুব খাঁ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। ভক্তেরা বললেন তিনি ভাল-মানুষ। ভক্ত-বৎসল রামকৃষ্ণদেব তাঁদের আশ্বাস দেন। চণ্ডীমঙ্গলের কালকেতুর তুলনা টানেন। কালুবীরও রাজচ্যুত হয়েছিল, দেবীর বরে আবার ফিরে আসে। রাজনৈতিক ইসলামের চেহারা-চরিত্র তাঁর অজানা। লোকায়ত-অশাস্ত্রীয় সাধনার ভাবনায় সব ভালমানুষের মঙ্গল কামনা করেন।
রামকৃষ্ণ ভারতীয় মধ্যযুগের মরমিয়া সাধনার ধারায় ধর্ম-সাধনার যে রূপটিকে উনিশ শতকে নিজের জীবনে মূর্ত করতে চেয়েছিলেন তাই এ-ভারতবর্ষে রাষ্ট্রিক ও সামাজিক হানাহানির তলায় পারস্পরিক বোঝাপড়ার পথ প্রস্তুত করেছিল। এই বোঝাপড়ার ইতিহাস আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ইতিহাসের থেকে প্রাচীন। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় অপরদেশের রাষ্ট্রীয় অনুশাসনের প্রতিক্রিয়ায় এই বোঝাপড়াকে ভুলে যদি ভারতীয় ধর্মের বহুত্বকে অস্বীকার করে রাষ্ট্রধর্মের একত্বকে গুরুত্ব দেওয়া হয় তা হলে এ ভূভাগের ধর্মপ্লাবনের উর্বর মৃত্তিকাকে বন্ধ্যা করা হবে।
রামকৃষ্ণের ধর্ম, রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করলে যা আসলে ‘‘শাস্ত্রীয় সম্মতির তটবন্ধনের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়’’, তা কখনও কোনও দিন হাফপ্যান্ট-পরা অনুশাসনবাদী রাষ্ট্রকামী স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের ধর্ম নয়। এই রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় অনুশাসনের মুহূর্তে আমরা যত মত তত পথের ঝর্নাধারায় স্নান করলে বেঁচে যেতে পারি।