Bangla News Dunia, বাপ্পাদিত্য:- এই বাংলার মধ্যেই আছে আরও একটা বাংলা। যে বাংলার মানুষেরা শুধু কলকাতার ভাষায় কথা বলেন না। বাংলা মানেই শুধু শহুরে বাবু–বিবিদের ভাষা নয়, পুরুলিয়ার শবর জনজাতির ভাষাও বাংলার অঙ্গ। দার্জিলিং পাহাড়ের গোর্খা জনজাতির ভাষা, সংস্কৃতিও বঙ্গের ঐতিহ্য। শহরতলির ভাষায় কথার টানও বঙ্গ–ভাষার অঙ্গ। যুগ যুগ ধরে কাজের খোঁজে বাংলায় আসা পরিযায়ী মানুষের ভাষা–সংস্কৃতি, খাদ্যভাসও বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে।
এই নানা ভাষার নানা দিক তুলে ধরেই বাংলাকে চেনাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। উচ্চ শিক্ষা দপ্তরের অধীনে থাকা ‘ইনস্টিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ় অ্যান্ড রিসার্চ’ বা আইএলএসআর–এর উদ্যোগে এ নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে এক ওয়ার্কশপের। নাম দেওয়া হয়েছে, ‘বাংলাকে জানো’! যেখানে বাংলার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা ভুল ধারণাও ভাঙা হবে।
এই সংস্থার গবেষণার জোরেই বাংলা ভাষা কিছু দিন আগেই ক্ল্যাসিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজের তকমা ছিনিয়ে এনেছে। এই সংস্থার সঙ্গে একযোগে ‘মহানির্বাণ ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ’ বাংলাকে চেনাবে। ওয়ার্কশপটি হবে মার্চের ১৭ থেকে ২১ তারিখ। যেখানে ১৮ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে যে কেউ চাইলেই অংশ নিতে পারেন। লেখক, ভাষাবিদ, সমাজকর্মী থেকে অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞরা এই ওয়ার্কশপ পরিচালনা করবেন।
এই কর্মশালায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে পরিযায়ী মানুষের সংস্কৃতির উপর। আইএলএসআর–এর বক্তব্য, বাংলার যে এত রকমের মেলা, উৎসব, পুজো–পার্বণের অস্তিত্ব দেখা যায়, তার জন্য বাংলার মিশ্র ভূ–প্রকৃতি ও বিচিত্র জনবৈচিত্রের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। দেশভাগের বহু আগে থেকেই বহু মানুষ পরিযায়ী হয়ে কলকাতা ও বাংলার অন্য জেলা শহরগুলিতে এসেছেন বিভিন্ন কাজের খোঁজে।
সেই সব পরিযায়ীদের সামাজিক–সংস্কৃতিক জীবনযাপনের ছাপ পড়েছে বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে। সরকারি এই স্বশাসিত সংস্থা মনে করছে, বাংলার মানুষের জনজীবন এই সব কিছুর দ্বারাই প্রভাবিত। তবে এ সব নিয়ে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চতর গবেষণার পরিসরের বাইরে চর্চা বিশেষ চোখে পড়ে না। এই অজ্ঞতার সুযোগ নিয়েই পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে ভুল ধারণার সূত্রপাত। আর এই সব ধারণা ভাঙতেই বাংলাকে চেনানোর এই উদ্যোগ।
আরও পড়ুন:– ৩০ লাখ পথ কুকুর হত্যার নিদান মরক্কোর, কেন এমন সিদ্ধান্ত ?
সংস্থার অধিকর্তা স্বাতী গুহ বলেন, ‘এই দেশটা যেমন নানা ভাষা, নানা মতের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ, এর আরও একটা উৎকৃষ্ট সংস্করণ আমাদের বাংলা। এখানে যুগে যুগে নানা মানুষ এসেছেন। দক্ষিণ ভারতীয়েরা এসে কলকাতায় থাকতে শুরু করেছিলেন বলেই হয়তো দক্ষিণ কলকাতায় এতো ভালো দোসা পাওয়া যায়। আবার শহরের বাইরে জনজাতির ভাষা, বাংলার নানা বর্গের মানুষের সংস্কৃতি এখন আমাদেরও সংস্কৃতি, উৎসব। সেটা কী ভাবে হলো, তা আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করব।’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক রাজ্যেশ্বর সিনহার মতো অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, সারা দেশে এক জাতীয় সংস্কৃতি, এক ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা চোখে পড়ছে—বাংলাও তার বাইরে নয়। রাজ্যেশ্বরের কথায়, ‘পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে কলকাতা শহরের বিশিষ্টদের ধারণা আছে যে তাঁদের বলা ভাষা, উচ্চারণই বোধহয় গোটা বাংলার স্বর। তবে সেটা যে কতটা ভুল, তা প্রতি ২০ কিলোমিটার অন্তর মানুষের সঙ্গে কথা বললেই ধরা পড়বে। এলাকাভেদে কথ্য বাংলা, শব্দচয়ন সব কিছুই পরিবর্তন হয়ে যায়। সেটাকে আরও বেশি করে আলোকবৃত্তে আনা দরকার।’
এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আরও বেশি করে মূলস্রোতের সাহিত্য, সিনেমা, গান, সংস্কৃতিতে বাংলার এই বহুত্বকে তুলে আনতে হবে। কেবল কলকাতা শহরেই এই উদ্যোগ আটকে রাখলে সাফল্য আসবে না। জেলায় জেলায় তা ছড়িয়ে দিতে হবে।’ আর এই ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ভার্চুয়াল মাধ্যম ব্যবহার করা যেতে পারে বলেই শীর্ষেন্দু মনে করেন।
নাট্য ব্যক্তিত্ব দেবেশ চট্টোপাধ্যায় এই উদ্যোগকে প্রশংসা জানিয়ে বলেন, ‘আমরা, শহুরে মানুষরা আমাদের উচ্চারণ, আমাদের ভাষা আমাদের সংস্কৃতিকে একটা মাপকাঠি হিসেবে ঠিক করে ফেলেছি। তাই মালদা থেকে কোনও ছেলে এসে তাঁর টানে বাংলা বললে আমাদের কানে লাগে। আমরা বলি, ‘বাংলাটা ঠিক করে বলো’। তাই এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাতেই হচ্ছে। এমন উদ্যোগ আরও হওয়া দরকার।’
আরও পড়ুন:– পশ্চিমবঙ্গে চালু হচ্ছে কার্বন ক্রেডিট কার্ড। কি কি সুবিধা মিলবে? জেনে নেওয়া যাক