একা মানেই একাকিত্ব‌ নয়, ‘সিঙ্গলহুড’ কেন বেছে নিচ্ছে মানুষ? জানতে চোখ রাখুন এই প্রতিবেদনে

By Bangla News Dunia Desk Bappaditya

Updated on:

Bangla News Dunia, বাপ্পাদিত্য:- ‘একা আছি, দিব্যি ভালো আছি।’ বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই এমন কথা বলেন পিয়া। সদ্য ৩০-এর কোঠা পার করা তরুণী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, বাকি জীবনটা বিয়ে না করেই কাটিয়ে দেবেন। এমনকী প্রেম, সম্পর্ক (এক্ষেত্রে কমিটমেন্ট) থেকেও দূরেই থাকবেন। একা থাকবেন, নিজের শর্তে বাঁচবেন, নিজের স্বপ্নপূরণ করবেন নিজের দমে। অথচ, জীবনে চলার পথে পেশায় ইঞ্জিনিয়ার পিয়াকে বার বার শুনতে হয় ‘ওর বিয়ে হয়নি’, ‘বয়স বাড়লে সঙ্গীর দরকার পড়ে’, ‘সঙ্গী না থাকলে একাকিত্ব গিলে খাবে’। কিন্তু এ সব কথায় গুরুত্ব দিতে নারাজ পিয়ার মতো শ’য়ে শ’য়ে নারী-পুরুষ। ‘সিঙ্গলহুড’কেই সেলিব্রেট করতে চাইছেন পিয়ার মতো অসংখ্যা তরুণ, তরুণী।

প্রেমে পড়েছেন বহু বার। কিন্তু বিয়ে করেননি কখনও। বরং, আত্মীয়-পরিজনকে নিয়েই দিন কাটে বছর পঁচাত্তরের কাকলি। প্রায় ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত দেখাশোনা চলেছিল বিয়ের জন্য। কিন্তু মনের মানুষ না পাওয়ায় সিদ্ধান্ত নেন নিজের মতো জীবন কাটাবেন তিনি। ছোট্ট বেসরকারি সংস্থায় অল্প মাইনের চাকরিতেই কাটিয়ে দিয়েছেন গোটা জীবন। কোনও দিন সঙ্গীর অভাব বোধ করেননি। আর্থিক সচ্ছলতা থাকায় এখন সেভিংসের উপর চলছে বার্ধক্য।

সরকারি চাকরি করতেন ৬৫ বছরের সজলবাবু। অল্প বয়সে পছন্দের মহিলাকেই বিয়ে করেন। কিন্তু পাঁচ বছরও সুখে সংসার করেননি। তখন বয়স মাত্র ৩২, ডিভোর্সের পর আর সম্পর্কে জড়ানোর কথা ভাবেননি। বরং, চাকরির পাশাপাশি ঘুরে-বেড়িয়ে যৌবন কাটিয়েছেন তিনি। আজ থেকে অনেকগুলো বছর আগে সজল, কাকলির মতো মানুষেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ‘সিঙ্গল’ থাকার—কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ পরিস্থিতির চাপে, আবার কেউ তিক্ত অভিজ্ঞতার জেরে। কিন্তু সিদ্ধান্তটা ছিল একান্ত নিজের, ব্যক্তিগত। এই চয়েসটা অনেকেই নিজের জীবনে প্রয়োগ করে থাকেন। সমাজের ট্র্যাডিশনাল (পড়ুন অর্থোডক্স বা রক্ষণশীল) ভাবনা এড়ানো আগেকার দিনে যতটা কঠিন ছিল, আজ তার তুলনায় অনেকটাই সহজ। কিন্তু ‘সিঙ্গলহুড’-এর বাড়তে থাকা সংখ্যা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে সমাজের কাছেই। সিঙ্গল থাকতে চাওয়ার পরিণতি কী? একাকী জীবনযাপন নাকি একাকিত্বের জীবনযাপন? ‘বিয়িং ইন্ডিপেন্ডেন্ট’, ‘বিয়িং অ্যালোন’ নাকি ‘ফিলিং লোনলি’—এগুলো কি একে-অন্যের সঙ্গে লিংকড?

আরো পড়ুন:- ১২ হাজারেরও বেশি শূন্যপদে সিভিক ভলেন্টিয়ার নিয়োগ করছে রাজ্য সরকার! রইলো বিস্তারিত

আজ ২০২৪-এ দাঁড়িয়েও এই ‘সিঙ্গল’ থাকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে শয়ে শয়ে মানুষ। বরং, সংখ্যাটা আরও বেড়েছে। তাদের মধ্যে কারও বয়স ২৭, কারও ৩৫, আবার কেউ ৪০ পেরিয়েছেন। প্রেম, সঙ্গী, সংসার—সব কিছু এই একটা জীবনেরই অংশ। তবু, একা থাকার সিদ্ধান্ত কেন নিচ্ছেন মানুষ?

মনোবিদ ও অভিনেত্রী সন্দীপ্তা সেন বলেন, ‘আজকাল কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না, সম্পর্কে অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে চায় না। একা থাকলে এই সবের ঝামেলা নেই। তাই ‘সিঙ্গলহুড’কে বেছে নিচ্ছেন অনেকে।’ সহমত পোষণ করে রিলেশনশিপ কোচ শ্রদ্ধাঞ্জলি দাশগুপ্ত বলেন, ‘বিয়ের পর অনেক কিছু বদলে যায়, লাইফস্টাইল বদলে যায়। সেগুলো আজকাল অনেকে চাইছে না। চট করে অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে চাইছে না কেউ।’ সত্যিই কি মানুষ দায়িত্ব নিতে চাইছে না? ‘মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়া’টা কি কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে মানুষের জন্য? ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে সঙ্গী খোঁজা অনেক বেশি সহজ হয়ে গিয়েছে। মুঠোভর্তি ফোনে ডেটিং অ্যাপ রয়েছে মনের মানুষ খোঁজার জন্য। সঙ্গীর মন জয় করার জন্য এআই চ্যাটবক্সও হাজির। তা হলে ‘একা’ থাকতে কেন চাইছে মানুষ? সন্দীপ্তা বলেন, ‘প্রযুক্তিগত উন্নতি আমাদের অনেক ক্ষতিও করে দিচ্ছে। এখন মানুষের ধৈর্য কমে গিয়েছে।’

২০২২ সালের ১১ জুন নিজেকে ভালোবেসে নিজেকেই বিয়ে করেছিলেন ক্ষমা বিন্দু। যে ট্রেন্ডের নাম ‘সোলোগ্যামি’। আত্মপ্রেমে মগ্ন হয়ে ‘সোলো হানিমুন’-এ গোয়াও গিয়েছিলেন তিনি। ‘সোলোগ্যামি’ ধারণার সঙ্গে হয়তো অনেকেই ‘রিলেট’ করতে পারবেন না, কিংবা ওয়াকিবহাল নন। কিন্তু আত্মপ্রেম, একা জীবনযাপন নতুন বিষয় নয়। তা ছাড়া নিজেকে ভালোবেসে, নিজের গুরুত্ব বুঝে, ভালো লাগার বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকায় কোনও ভুলও নেই। তবু পাশে কেউ থাকলে ভালো লাগে—এই ধারণাও রয়েছে অনেকের মধ্যে।

ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে ক্লিক করে যেমন সঙ্গী বেছে নেওয়া যায়, তেমনই সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্লক করে বা গোস্টিং করেও সম্পর্ক ভেঙে দেওয়া যায় এক নিমেষে। তা ছাড়া সম্পর্কে থাকলেই যে কমিটমেন্ট (প্রতিশ্রুতি) দিতে হবে, তেমনটাও আর নেই। এখন সম্পর্কের অনেক নাম, নানা সংজ্ঞা। কিন্তু এই ব্লক-আনব্লকের খেলায় ‘সিঙ্গলহুড’কে বেছে নেওয়ার আরও কারণ রয়েছে। সাম্প্রতিকতম একটি সমীক্ষা বলছে, আমেরিকা ও কানাডার প্রায় ৩০ শতাংশ নাগরিক একা থাকতেই পছন্দ করেন।

মনোবিদ শতভিষা চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘মানুষ একা থাকতে ভালোবাসে বলে যে ‘সিঙ্গলহুড’কে বেছে নিচ্ছে এমনটা নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, সঠিক মানুষ, মনের মানুষ পাচ্ছেন না বলেই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন জীবনটা একা কাটাবেন।’ সদ্য এক বছরের বিবাহ বার্ষিকী পালন করা সন্দীপ্তাও স্বীকার করেন যে, তিনি সঠিক মানুষটা পেয়েছেন বলেই বিয়ে করেছেন। তাঁর মতে, যতক্ষণ সঠিক মানুষটা জীবনে আসছে, বিয়ে করাই উচিত নয়।

সঠিক মানুষ জীবনে আসার পরও সম্পর্কে জড়াতে চান না অনেকে। বিয়ে অনেক পরের বিষয়। সামান্য প্রেম করার কথাও অনেকে ভাবেন না। এখানে দু’টো বিষয় কাজ করে বলে জানিয়েছেন শতভিষা। তিনি বলেন, ‘পূর্ব অভিজ্ঞতা তিক্ত হলে, আগে যদি টক্সিক রিলেশনশিপে থাকে, সে ক্ষেত্রে একটা ট্রমা কাজ করে। আবার কেউ যদি দেখেন তাঁর আশেপাশের মানুষ সম্পর্কের বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে খুশি নেই, সেই অভিজ্ঞতা থেকেও অনেকে একা থাকার সিদ্ধান্ত নেন।’ দীর্ঘ দিন একসঙ্গে সংসার করার পরও ডিভোর্স নিচ্ছেন স্বামী-স্ত্রী। আবার কেউ কেউ ১০ বছর প্রেম করেছেন। কিন্তু বিয়ের ৩ বছর হতে না হতেই ডিভোর্স চাইছেন। এমন ঘটনা আখছার ঘটছে। কখনও বাড়িতে, কখনও বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে। এই এক্সপেরিয়েন্সও ‘সিঙ্গলহুড’ বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ। মা-বাবার মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর ভালো সম্পর্ক না থাকলে সেটাও ‘ট্রমা’ হয়ে দাঁড়ায় বাচ্চার কাছে। এটাও কিন্তু ‘সিঙ্গল’ থাকার অন্য কারণ হতে পারে বলে মনে করেন মনোবিদরা।

পুরনো প্রেম যে টক্সিক ছিল, তাও কিন্তু সবার ক্ষেত্রে জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে, অ্যাটাচমেন্টের কথা না বললেই নয়। একসঙ্গে থাকতে থাকতে একে-অন্যের প্রতি টান তৈরি হয়। দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো কাজে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে মানুষটা সারাক্ষণ সঙ্গে রয়েছেন, তাঁর প্রতি অ্যাটাচমেন্ট তৈরি হয়। কোথাও গিয়ে একসঙ্গে থাকাটা একে-অন্যের কাছে অভ্যাসে পরিণত হয়। ঠিক যে রকমটা ‘বেলাশেষে’-র আরতি মজুমদারের ছিল। ওই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, তিনি বলেছিলেন, ‘এই অভ্যাসগুলোই আমার কাছে প্রেম।’ আর ঠিক যে মুহূর্তে সম্পর্ক ভাঙে, অভ্যাসগুলোকেও বদলে ফেলতে হয়। তখনই বোঝা যায় যে, মানুষটার প্রতি কতখানি টান ছিল, কতটা ভালোবাসা ছিল। সেই অভ্যাস থেকে নিজেকে বের করতে, অ্যাটাচমেন্ট কমাতে অনেক খেসারত দিতে হয়। মন ভাঙার কষ্ট ভোলা সহজ নয়। সেই কষ্টের মুখোমুখি কেউ কেউ হতে চান না। ওই যে কথায় আছে ‘ন্যাড়া বেল তলায় এক বারই যায়’। এই ব্রেকআপ, ডিভোর্সের ভয় অনেকের কাছেই দুঃস্বপ্নের মতো। এখান থেকেও অনেকে সিদ্ধান্ত নেন একা থাকার।

বছর ২৫ হোক বা ৪৫, কমবেশি অনেকেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন একা থাকার, বিয়ে না করার। তবে, ২০-৩০ বছর বয়সিরা প্রথমেই সিদ্ধান্ত নেন না যে, তাঁরা কোনও দিন বিয়ে করবেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, তাঁরা সঠিক মানুষটার খোঁজ করেন। যখন ৪০-এর দোরগোড়ায় পৌঁছে যান, তখনই সিদ্ধান্ত নেন যে বাকি জীবনটাও একা নিজের মতো দিব্যি হেসে খেলে কাটিয়ে দেব। কিন্তু সত্যি কি হেসে খেলে কাটানো যায়? সন্দীপ্তা বলেন, ‘এখন একা থাকাটা চয়েস। মানুষ এখন নিজের শর্তে বাঁচে। আগেকার দিনে এই সুবিধা ছিল না। এখন মানুষ নিজের মতো করে ভালো থাকতে জানে।’ সেই অর্থে দেখতে গেলে, মানুষ যতক্ষণ না নিজেকে ভালোবাসতে পারছে, নিজেকে ভালো রাখতে পারছে, সে কারওর সঙ্গেই মানিয়ে গুছিয়ে থাকতে পারবে না। তা ছাড়া মানুষের কাছে ‘চয়েস’ রয়েছে নিজের জীবনটাকে নিজের মতো করে সাজানোর।

এই সমাজ বদলের কাজ একদিনে সম্ভব নয়। কিন্তু পরিবর্তনের হাওয়া সব সময় বয়ে চলে। তবুও বহু মানুষের ধারণা একা থাকা মানেই একাকিত্ব। ঘটনাচক্রে তা একদমই নয়। শতভিষা বলেন, ‘একাকিত্ব বা loneliness বিষয়টা একদম আলাদা। একা থাকা মানেই যে তাঁকে একাকিত্ব গ্রাস করবে সেটা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সঙ্গীর সঙ্গে থেকেও কেউ কেউ একা (lonely), বন্ধু-বান্ধব, পরিজন-আত্মীয়ের মাঝে থেকেও সে একাকিত্বে ভুগছে। আবার কেউ সঙ্গী ছাড়া দিব্যি ভালো আছে, আনন্দে আছে।’

একা থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কার কাছে কতটা সহজ বা কতটা কঠিন, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। জীবনে চলার পথে বহু মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। কেউ ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে, কেউ মেন্টর, আবার কেউ সঙ্গী। সম্পর্কে জড়াবে কি না, জীবনসঙ্গী কেমন হবে পুরোটাই ব্যক্তি বিশেষে নির্ভর করে। তবে, এ ক্ষেত্রে ‘ডিয়ার জিন্দেগি’ থেকে জাহাঙ্গির খানের একটা ডায়লগ ভীষণ খাটে। ‘উই আর অল আওয়ার ওন টিচার্স ইন দ্য স্কুল অফ লাইফ’ (We are all our own teachers in the school of life)। অর্থাৎ, জীবনই শিখিয়ে দেবে কার কাকে কখন প্রয়োজন, কে থাকবে আর কে সঙ্গীর সঙ্গে সংসার পাতবে।

আরো পড়ুন:- চাপে পড়ে নতিস্বীকার, সব ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক ইউনূসের, জানতে পড়ুন বিস্তারিত

আরো পড়ুন:- ব্রেন তীক্ষ্ণ রাখতে চান? এই ব্যায়ামগুলিতে স্মৃতিশক্তি প্রখর থাকবে- বুদ্ধি বাড়বে মস্তিষ্কের

আরো পড়ুন :- নতুন বছরেই নির্বাচনের ইঙ্গিত, বাংলাদেশে ইউনূসের মেয়াদ কি তবে শেষের দিকে ?

Bangla News Dunia Desk Bappaditya

মন্তব্য করুন