Right to Disconnect: “আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম এবং আট ঘণ্টা নিজের জন্য” — উনবিংশ শতাব্দীতে শ্রমিক আন্দোলনের এই স্লোগানটি আধুনিক কর্মঘণ্টার ভিত্তি তৈরি করেছিল। কিন্তু ডিজিটাল যুগে স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেটের দৌলতে কাজের সময় আর নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আটকে নেই। অফিস ছুটির পরেও বস বা অফিসের ফোন, ইমেল কর্মচারীদের ব্যক্তিগত জীবনে হানা দেয়। এই সমস্যা থেকে মুক্তি দিতেই এবার লোকসভায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিল পেশ করলেন এনসিপি (এসপি) সাংসদ সুপ্রিয়া সুলে।
শুক্রবার লোকসভায় পেশ করা এই ‘প্রাইভেট মেম্বার্স বিল’-এ প্রস্তাব করা হয়েছে যে, কাজের নির্দিষ্ট সময়ের পর কর্মচারীদের অফিসের ফোন বা ইমেলের উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকার অধিকার দেওয়া হোক। একেই বলা হচ্ছে ‘রাইট টু ডিসকানেক্ট’ (Right to Disconnect)। শুধু সুপ্রিয়া সুলে নন, কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুরও একই ধরনের একটি বিল পেশ করেছেন, যার মূল লক্ষ্য কর্মচারীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা এবং কর্মজীবনের ভারসাম্য বজায় রাখা।
কেন এই বিলের প্রয়োজন?
সুপ্রিয়া সুলের পেশ করা ‘রাইট টু ডিসকানেক্ট বিল, ২০২৫’-এর মূল উদ্দেশ্য হল কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের মধ্যে টানাপোড়েন কমানো। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের একটি রিপোর্টের উল্লেখ করে বিলে বলা হয়েছে, যদি কোনও কর্মচারীকে সারাক্ষণ কাজের জন্য উপলব্ধ থাকতে হয়, তবে তাঁদের মধ্যে অতিরিক্ত কাজের চাপ, ঘুমের অভাব এবং মানসিক ক্লান্তির মতো সমস্যা দেখা দেয়।
সারাক্ষণ ফোন বা ইমেলের উত্তর দেওয়ার এই মানসিক চাপকে বলা হচ্ছে ‘টেলিপ্রেসার’ (Telepressure)। গবেষণায় দেখা গেছে, ছুটির দিনেও বারবার ইমেল চেক করা বা কাজের মেসেজ দেখা কর্মচারীদের মস্তিষ্কের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে ‘ইনফো-ওবেসিটি’ (Info-obesity) নামক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
বিলে কী কী প্রস্তাব রাখা হয়েছে?
সাংসদ সুপ্রিয়া সুলের এই বিলে কর্মচারীদের স্বার্থে বেশ কিছু বৈপ্লবিক প্রস্তাব রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত বিলের প্রধান দিকগুলি নিচে আলোচনা করা হল:
- কল প্রত্যাখ্যানের অধিকার: অফিস আওয়ারের পর নিয়োগকর্তা বা বস যোগাযোগ করতেই পারেন, কিন্তু কর্মচারী সেই ফোন বা ইমেলের উত্তর দিতে বাধ্য থাকবেন না। কাজের সময়ের বাইরে এই যোগাযোগের উত্তর না দিলে কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।
- ওয়েলফেয়ার অথরিটি গঠন: কর্মচারীদের এই অধিকার সুনিশ্চিত করতে একটি ‘এমপ্লয়িজ ওয়েলফেয়ার অথরিটি’ গঠন করতে হবে।
- সমীক্ষা ও তথ্য সংগ্রহ: এই অথরিটি বা কর্তৃপক্ষ কাজের সময়ের বাইরে ডিজিটাল এবং যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি সমীক্ষা চালাবে।
- ওভারটাইম ও নিয়মাবলী: ১০ জনের বেশি কর্মী আছেন এমন প্রতিটি সংস্থাকে কর্মীদের বা তাঁদের ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা করে কাজের সময়ের বাইরের শর্তাবলী ঠিক করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের বাইরে কাজ করলে সাধারণ হারের চেয়ে বেশি ওভারটাইম বা অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দিতে হবে।
- কাউন্সেলিং ও ডিজিটাল ডিটক্স: সরকারের উদ্যোগে এবং কোম্পানিগুলির পরামর্শে কর্মচারীদের জন্য কাউন্সেলিং পরিষেবা চালু করতে হবে। পাশাপাশি ‘ডিজিটাল ডিটক্স সেন্টার’ গড়ে তোলার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
- জরিমানা: যদি কোনও কোম্পানি এই নিয়ম না মানে, তবে তাদের পেনাল্টি হিসেবে কর্মচারীদের মোট পারিশ্রমিকের ১ শতাংশ জরিমানা দিতে হবে।
শশী থারুরের প্রস্তাব ও বিলের ভবিষ্যৎ
সুপ্রিয়া সুলের পাশাপাশি কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুরও ‘অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশনস কোড (সংশোধনী) বিল, ২০২৫’ পেশ করেছেন। এই বিলেও কাজের সময়সীমা নির্ধারণ, ‘রাইট টু ডিসকানেক্ট’-এর অধিকার এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার বিষয়গুলি তুলে ধরা হয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালেও সুপ্রিয়া সুলে অনুরূপ একটি বিল এনেছিলেন। গত সেপ্টেম্বরে কেরালা কংগ্রেসের (এম) বিধায়ক ডঃ এন জয়রাজও কেরালায় এই ধরণের একটি বিলের প্রস্তাব করেছিলেন।
তবে বাস্তবে ‘প্রাইভেট মেম্বার্স বিল’ বা ব্যক্তিগত সদস্যদের বিল পাশ হওয়া বেশ কঠিন। ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত মাত্র ১৪টি এমন বিল আইনে পরিণত হয়েছে। শেষবার ১৯৭০ সালে এমন একটি বিল সংসদীয় অনুমোদন পেয়েছিল। তবে এই বিল পাশ হোক বা না হোক, কর্মজীবীদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং ‘অফিস কল’ নিয়ে এটি জাতীয় স্তরে একটি বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছে।














